মৌসুমে চাষিদের কাছে ব্যবসায়ীরা আকারভেদে আলু কিনেছিলেন গড়ে কেজি ১০ টাকায়। এসব আলু হিমাগারে মাস দুয়েক রাখার পরেই বিক্রি শুরু হয় কেজি ২৮-৩০ টাকা। বর্তমানে সেই আলু হিমাগার থেকেই পাইকারি বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৪৪ টাকা কেজি। বাজারে তা খুচরা বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। এভাবে দাম বেড়ে যাওয়ায় খোদ চাষিরাও অনেকে খাওয়ার জন্য আলু কিনে খেতে পারছেন না। আলুর বাজারের এমন চিত্র রংপুরের আট উপজেলাসহ আশপাশের জেলাগুলোয়।
রংপুর অঞ্চলে সাধারণত কার্ডিনাল, স্থানীয় জাত সাদা পাটনি, শীল ও ঝাউ বিলেতি আলুর চাষ হয়। বর্তমানে কার্ডিনাল জাতের আলু খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৪৩ টাকা, সাদা আলু ৫০ টাকা, শীল ও ঝাউ বিলেতি আলু কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়। খুচরা ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, তাঁদের হিমাগার থেকেই কিনতে হচ্ছে প্রতি কেজি আলু গড়ে ৪৪ টাকায়।
১০ টাকা কেজির আলু কীভাবে ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তা জানতে ৯ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৫ জন আলুচাষি, ২৫ জন ব্যবসায়ী, চারজন কৃষি কর্মকর্তা, ২০ জন শ্রমিক ও ১০ জন হিমাগার ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের ভাষ্য, আলু উৎপাদনে কেজিপ্রতি চাষিদের খরচ পড়েছে প্রায় ৯ টাকা। গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আলু তুলে চাষিরা জমি থেকে বিক্রি করেছেন ১০-১১ টাকা কেজি। গত মার্চে ব্যবসায়ীরা ৫০ কেজির বস্তায় ভরে আলু হিমাগারে রেখেছেন। প্রতিটি বস্তা কিনতে হয়েছে ৫৫ টাকায়। হিমাগার ভাড়া দিতে হচ্ছে বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা। প্রতি কেজি আলুতে শ্রমিকসহ পরিবহন খরচ পড়েছে
দুই টাকা। সব মিলিয়ে প্রতি কেজি আলুতে ব্যবসায়ীদের খরচ পড়েছে ২০ টাকা। আর কৃষক পর্যায়ে খরচ ১৮ টাকা। সেই আলু প্রকারভেদে বর্তমানে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে কেজি গড়ে ৪৪ টাকা এবং খুচরা বিক্রি হচ্ছে গড়ে ৪৮ টাকা। তবে মানভেদে কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা পর্যন্ত।
রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার জেলায় ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ ৪ হাজার ৫৫৬ মেট্রিক টন। চাহিদা ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৫৮ মেট্রিক টন। ৩৯টি হিমাগারের ধারণক্ষমতা ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৮০ মেট্রিক টন। ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব হিমাগারে আলু মজুত ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ১৯২ মেট্রিক টন।
বদরগঞ্জের শাহজালাল কোল্ড স্টোরেজের স্টোর কিপার শাহাদত হোসেন বলেন, অল্পসংখ্যক কৃষক হিমাগারে আলু রাখলেও ইতিমধ্যে এজেন্ট ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। হিমাগার থেকে কিছু বের করে এজেন্ট ও ব্যবসায়ীরা খরচ তুলে নিয়ে চিন্তামুক্ত আছেন। এখন তাঁরা বাকি আলু আরও বেশি দাম পাওয়ার আশায় হিমাগারে রেখেছেন। তাঁদের হিমাগারে এবার আলু ছিল ২ লাখ ৮ হাজার ৬৭২ বস্তা। ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বের হয়েছে ১ লাখ ৩ বস্তা।
বাজারে ক্রমান্বয়ে আলুর দাম বাড়ার জন্য চাষি ও হিমাগারের ব্যবস্থাপকেরা দুষছেন মজুতদার ব্যবসায়ীদের। তাঁদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বের করছেন অত্যন্ত ধীরগতিতে। এ কারণে সরবরাহ কমে দাম বেড়েছে। আরও দাম বাড়ার আশায় হিমাগার থেকে আলু বের করছেন না। চুক্তি অনুযায়ী হিমাগারগুলোতে আগামী ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত আলু সংরক্ষণে থাকবে।
জেলায় আলুর চাহিদা ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৫৮ মেট্রিক টন। ৩৯টি হিমাগারের ধারণক্ষমতা ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৮০ মেট্রিক টন। ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব হিমাগারে আলু মজুত ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ১৯২ মেট্রিক টন।
জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রংপুর জেলায় এবার আলু উৎপাদন হয়েছে ১৪ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদা ১ লাখ ২৯ হাজার মেট্রিক টন। জেলায় হিমাগার রয়েছে ৩৯টি। আলু সংরক্ষণ করা হয়েছিল ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৮০ মেট্রিক টন। গত ৩০ আগস্ট পর্যন্ত হিমাগার থেকে আলু বের করা হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯১ টন।
তারাগঞ্জের সিনহা কোল্ড স্টোরের ব্যবস্থাপক দুলাল শাহ ও এন এন কোল্ড স্টোর লিমিটেডের ব্যবস্থাপক শরিফুল ইসলাম জানান, তাঁদের দুটি হিমাগারে আলু ছিল ৩ লাখ ৬৭ হাজার বস্তা। ইতিমধ্যে বের হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার বস্তা। হিমাগারে থাকা বাকি সব আলু ব্যবসায়ীদের কবজায় আছে।
বর্তমানে বাজারে আলুর দাম চড়া থাকার পরও ব্যবসায়ী এবং এজেন্টরা কেন আলু বের করছেন না, জানতে চাইলে বদরগঞ্জের আলু ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম, লিয়াকত আলী, রকিবুল ইসলাম ও সফিয়ার রহমান এবং তারাগঞ্জের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম, মিলন মিয়া, জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন, সামনে ঝড়বৃষ্টি হলেই বাজারে অন্য সবজির সরবরাহ কমে যাবে। তখন আলুর চাহিদা ও দাম আরও বেড়ে যাবে। এ কারণে তাঁরা এখন হিমাগার থেকে পর্যাপ্ত আলু বের করছেন না।
গত বছর আলু রেখে ১০ লাখ টাকা লস খাইছি। এইবার সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে আরও কিছু লাভ থাকবেমিলন হোসেন, আলু ব্যবসায়ী, তারাগঞ্জ
শাহজালাল কোল্ড স্টোরেজের ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলামের আলু আছে ১৬ হাজার বস্তা। তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়ে আলু কিনে হিমাগারে রাখছি। দাম বাড়লে ইচ্ছেমতো বিক্রি করব, এখানে অন্যায়ের কিছু নাই।’ তারাগঞ্জের ব্যবসায়ী মিলন হোসেন বলেন, ‘গত বছর আলু রেখে ১০ লাখ টাকা লস খাইছি। এইবার সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে আরও কিছু লাভ থাকবে।’
উৎপাদনের তুলনায় রংপুরে হিমাগার অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগারের অভাবে আলু পচে নষ্ট হয়। এ কারণে বছর শেষে আলুর দামটা বাড়ে।
রংপুরের হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, এবার আলুর চাহিদা বেশি। অন্য বছরগুলোতে এ সময়ে হিমাগারগুলো থেকে অল্প আলু বের হতো। তুলনামূলক এবার বেশি আলু বের হয়েছে। তবুও দাম চড়া। বাজার স্বাভাবিক রাখতে আলু ব্যবসায়ীদের হিমাগার থেকে আলু বের করে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে চুক্তি মোতাবেক গ্রাহকদের আলু নভেম্বর পর্যন্ত হিমাগারে রাখতে তাঁরা বাধ্য।