শেখ ওসমান গণির বয়স ৫৪ বছর। সাইকেল-রিকশা মেরামত করে জীবিকা চালান। পথের ধারে কাজটি শুরু করেছিলেন কিশোর বয়সে। সেটা ৪০ বছর হয়ে গেল। সংসারের খরচ চালাতে এই কাজই একমাত্র সম্বল তাঁর। কখনো হাল ছাড়েননি। এই পেশার বাইরে তাঁর আলাদা একটি সত্তা আছে। তিনি সাহিত্য চর্চা করেন। কবিতা, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লেখেন। লেখার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি একাধিকবার সম্মাননাও পেয়েছেন।
ওসমানের বাড়ি রংপুর শহরের নীলকণ্ঠ এলাকায়। পরিবারে আছেন স্ত্রী ও এক ছেলে। ২০১৯ সাল থেকে ছেলে চাকরি করছেন।
ওসমান গণি প্রতিদিন ভোরে রংপুর টাউন হল চত্বরের প্রধান সড়কের পাশে যান। সেখানে সাইকেল-রিকশা মেরামতের কাজ করেন। বুধবার দুপুরে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। হাসিমুখে তিনি জানালেন তাঁর সাহিত্যচর্চার কথা। বললেন, তিনি নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন। কবিতা ও ছোটগল্প লেখেন। রংপুরের সব কটি স্থানীয় পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয়েছে। এ ছাড়া রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া তাঁর শখ। রচনা লিখে তিনি বেশ কয়েকটি ক্রেস্ট ও সম্মাননা পেয়েছেন।
রংপুরে মৌচাক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম জীবন বলেন, ওসমান সাইকেল–রিকশা মেরামতের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাদের সংগঠন তাঁকে সম্মাননা জানিয়েছে।
আলাপে আলাপে ওসমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে নীলফামারীর জলঢাকা থেকে রংপুরে আসেন তাঁর বাবা নূরুল হক। শহরের নীলকণ্ঠ এলাকার একটি বাড়িতে কাজের বিনিময়ে বসবাস করতেন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে ওসমান তৃতীয়। তিনি বাড়ির পাশে স্থানীয় খটখটিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এর পর থেকে সাইকেল-রিকশা মেরামতের কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন মালিকের অধীনে শহরের দেওয়ানবাড়ি, কাচারি বাজার এলাকায় বহু বছর কাজ করেছেন। একসময় এই কাজে নিজেই ওস্তাদ হয়ে যান।
ছোটবেলা থেকে পত্রিকা পড়ার নেশা ওসমানের। জানালেন, সাহিত্য পাতা তাঁর সবচেয়ে পছন্দের। একপর্যায়ে তিনি কবিতা, প্রবন্ধ ও ছোটগল্প লেখা শুরু করেন। স্থানীয় পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হতে থাকে। কিন্তু সাইকেল–রিকশা মেরামতের কাজ তিনি ছাড়েননি। লেখালেখি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়তাম। পত্রিকা পড়তাম। গল্প–কবিতা লিখে অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমি সাইকেলের মেকানিক হলেও সবাই আমাকে কবি বলেন।’
স্থানীয় পত্রিকা যুগের আলোর সাহিত্য সম্পাদক নজরুল মৃধা বলেন, ‘আমাদের পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কবিতা লেখেন। ছোটগল্পও লেখেন। সাইকেলের মেকানিক হলেও সাহিত্য চর্চার কারণে তাঁকে আমরা সম্মান করি।’
সাইকেল–রিকশা মেরামতের কাজ চালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ওসমান বলেন, ‘সংসার চলবে কী করে! কিছু করে তো আয়রোজগার করতে হবে। তাই পুরোনো পেশা ছাড়তে পারিনি। সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত কাজ করে আয় হয় ৩০০ টাকার মতো। এই টাকায় বর্তমান বাজারে সংসার চালাতে কষ্টই হয়। তবে কারও কাছে হাত পাততে চান না তিনি। এই আয় দিয়েই সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন। অনেক আগে কেনা জায়গায় আধা পাকা ঘর বানিয়ে থাকেন বলে কিছুটা স্বস্তি আছে জীবনে।
রংপুর বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের সহকারী পরিচালক আবেদ হোসেন বলেন, শেখ ওসমান গণি সাইকেল–রিকশা মেরামতের পাশাপাশি নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করেন। নানা দিবসে গণগ্রন্থাগার আয়োজিত প্রতিযোগিতায় একাধিকবার পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।