বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেছেন, জাতীয় ওষুধ নীতির কারিগর জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তাঁর মানসিক দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম, মানুষের জন্য ভালোবাসা—এই সবকিছুর কারণে তিনি হয়ে ওঠেন মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশা পূরণের অন্যতম জায়গা।
জাতীয় ওষুধ নীতি ১৯৮২ প্রণয়নের ৪২ বছর উপলক্ষে ‘অর্জন ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে এ কথাগুলো বলেন অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান। সেমিনারের আয়োজন করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
আজ শনিবার সকাল ১০টায় সাভারের আশুলিয়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পিএইচএ অডিটরিয়ামে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতারের সঞ্চালনায় সেমিনারে আলোচক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন ও বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টারের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক কাজী ইকবাল উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ওষুধশিল্পের প্রবৃদ্ধি সক্ষমতা ও আকারের সম্প্রসারণ, ওষুধের মূল্য, ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে ওষুধ নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৭ সালে ভারত–পাকিস্তান বিভক্তির পর থেকে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তান সরকার ওষুধসংক্রান্ত কোনো আইন বা নীতি প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। সরকারকে দেশের ওষুধ খাতের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রদান করার জন্য ১৯৮২ সালে জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলামকে সভাপতি করে আট সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অন্তর্ভুক্তি পুরো প্রক্রিয়ার গন্তব্যই বদলে দেয়।
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, স্বাধীনতার আগে বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ চলে যেত ওষুধ আমদানি করতে গিয়ে। যে ওষুধগুলো আমদানি করা হতো, তার অধিকাংশই ছিল অপ্রয়োজনীয়। পাকিস্তান আমলে ওষুধ কোম্পানি প্রতিষ্ঠার যে বৈষম্য ছিল, স্বাধীনতার পর সেটি দূর করতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ওই সময় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে নির্দেশ দিলেন ওষুধ কোম্পানিকে অগ্রাধিকার দিতে। এর ফলে পরে দেশে অনেকগুলো ওষুধ কোম্পানি গড়ে ওঠে।
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে ওষুধের লড়াইয়ের যে ইতিহাস, সেটি স্বদেশি আন্দোলন দিয়েই শুরু। এখন পর্যন্ত আমরা সেই স্বদেশি আন্দোলনের মধ্যেই রয়েছি। এখন আমাদের বাৎসরিক চাহিদার শতকরা ৯৮ ভাগ ওষুধ আমরা নিজেরাই তৈরি করছি। আমাদের এপিআইয়ের কারখানাগুলো যদি শুরু হয় যেটি এপিআই পার্ট-২ নামে পরিচিত, তাহলে আমাদের ওষুধের দামও কমে যাবে এবং আমরা রপ্তানি অনেক বাড়াতে পারব। জাফর ভাই বিভিন্ন সময় অপ্রয়োজনীয় ওষুধের বিরুদ্ধে, ওষুধ নীতি নিয়ে যে সংগ্রাম করেছেন, তা আমাদের প্রতিনিয়তই উৎসাহ জোগায়।’
কাজী ইকবাল বলেন, ‘জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। তিনি জাতীয়তাবাদী বোধ থেকে কাজ করতেন। তাঁর আলোচনার মধ্যে দেশ ও মানুষের কথা সব সময়ই শোনা যেত, যা আমাদের মুগ্ধ করত। আমাদের ওষুধ নীতির একটি বৈশিষ্ট্য হলো আমরা সবার জন্য ওষুধের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পেরেছি। একই সঙ্গে দেশে ওষুধের উৎপাদনসহ প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে পেরেছি।’
পরিচালক ফরিদা আখতার বলেন, জাফর উল্লাহকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাঁর কাজগুলোকে ভুলে গেলে চলবে না, তাঁর অসম্পূর্ণ কাজগুলোকে সম্পূর্ণ করতে হবে। ওষুধ নীতি করাটা একটা সংগ্রাম ছিল। সে সময় ১ হাজার ৭৪২টি ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, এটি করা অতটা সহজ কাজ ছিল না। ১৬টি ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে এটি করা হয়েছিল। ওই সময় ওষুধ নীতি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলোর অন্যায় কাজগুলোকে সামনে নিয়ে আসে। ওষুধকে পণ্য করা যাবে না। জীবিত থাকা অবস্থায় জাফরুল্লাহ চৌধুরী ওষুধের মূল্যের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দেখিয়েছিলেন বাজারে যে ওষুধটার মূল্য দুই টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়, সেটি ছয় টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’
পরে সেমিনারে মুক্ত আলোচনায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি শিরিন হক, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য লায়লা পারভিন বানু, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ডায়ালাইসিস সেন্টারের সাবেক উপপরিচালক লিয়াকত আলী এবং হাবিবুল্লাহ তালুকদার অংশ নেন।