ধর্ষণের পর পুড়িয়ে হত্যা

‘সীমারেরা হামার ময়নাডাক এত কষ্ট দিয়ে মারল’

বগুড়ার শিবগঞ্জে ধর্ষণের পর আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া মাদ্রাসাছাত্রীর স্বজনদের আহাজারি। বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার একটি গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

‘হামার পরান পাখিডা মরার আগে এত কষ্ট সহ্য পালো। ৪০টা দিন আগুনে পোড়া গা লিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করল। কত চেষ্টা, কত কী করলু; কিন্তু পরান পাখিডাক বাঁচাবার পারনু না।’

বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে ধর্ষণের পর ধরিয়ে দেওয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া মাদ্রাসাছাত্রীর (১৭) মা আহাজারি করতে করতে আজ বৃহস্পতিবার এসব কথা বলেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর জুমার নামাজের সময় বাড়িতে একা পেয়ে ওই মাদ্রাসাছাত্রীকে (১৭) ধর্ষণ করেন এক তরুণ। পরে তাকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা চালান। প্রায় দেড় মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর গত মঙ্গলবার বিকেলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে তার মৃত্যু হয়।

ময়নাতদন্তের পর গতকাল বুধবার রাতে ওই মাদ্রাসাছাত্রীর লাশ বগুড়ায় এসে পৌঁছায়। আদরের নাতনিকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তার দাদি। কান্না আর আহাজারিতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি। বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘হামার ময়নাডাক তোরা অ্যানা দে। সীমারেরা হামার ময়নাডাক এত কষ্ট দিয়ে মারল, পুলিশ কিচ্চু করবার পারল না।’

আজ ভোরে শিবগঞ্জে ওই মাদ্রাসাছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির অদূরে উৎসুক নারী-পুরুষের জটলা। সেখানে সুগন্ধি সাবান ও লোবান জলে কিশোরীর শেষ গোসলের কাজ চলছে। বাতাসে ভাসছিল আতর, লোবান, ধূপ-কর্পূরের ঘ্রাণ। স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে প্রতিবেশীরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না।

স্বজনদের জড়িয়ে ধরে মেয়ের শোকে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন বাবা। বিলাপ করে বলছেন, ‘৪০টা দিন ধরে মা হামার এত কষ্ট করল, মরার আগে দুনিয়াতে এত কষ্ট আর কেউ করেনি। আগুনে পোড়া দগ্ধ গা লিয়ে দিনে–রাতে যন্ত্রণায় ছটফট করেও বাঁচপার পারল না। মরণের কাছে হারে গেল। হামার মেয়েডাক যারে এভাবে যন্ত্রণা মারে ফেলল, হামি তারকেরে দ্রুত ফাঁসি চাই।’

নিহত কিশোরীর এক প্রতিবেশী বলেন, ‘মেয়েডা এত ভালো ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। ধর্মভীরু ছিল। সেই মেয়েডাক এভাবে হত্যা করল পাষণ্ডরা। মেয়েডা মারা যাওয়ার খবরে গোটা গ্রাম শোকে স্তব্ধ।’

পুলিশ ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই কিশোরী স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়ত। ৭ সেপ্টেম্বর কিশোরীর মা-বাবা আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় মেয়েটি বাড়িতে একা ছিল। পরদিন দুপুরে বখাটে তরুণ সাইফুল ইসলাম (২০) বাড়িতে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করেন। মৃত ভেবে কিশোরীর গায়ে পাটের বস্তা ও কাপড় পেঁচিয়ে সয়াবিনের তেল ঢেলে আগুন দেন ওই তরুণ। এতে কিশোরীর দুই হাত, ডান গাল, গলার নিচের অংশ, বাঁ পাসহ শরীরের বেশির ভাগ অংশ দগ্ধ হয়। আগুনের তাপে কিশোরীর জ্ঞান ফিরলে তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা এসে তাকে উদ্ধার করেন। প্রথমে তাকে বগুড়ার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে ঢাকায় আনা হয়।

ওই কিশোরীর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযুক্ত সাইফুলকে আটক করে থানায় খবর দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁকে হেফাজতে নেয়। কিশোরীর বাবা বাদী হয়ে ৯ সেপ্টেম্বর শিবগঞ্জ থানায় তিনজনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। অন্য দুই আসামি রঞ্জু (৪০) ও নাঈম (২৩) পলাতক। মামলার প্রধান আসামি সাইফুল ইসলাম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

নিহত কিশোরীর চাচা অভিযোগ করে বলেন, মামলার প্রধান আসামি সাইফুলকে আটক করে গ্রামবাসী পুলিশের হাতে তুলে দেন। মামলার দুই আসামি এখনো পলাতক। আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের তৎপরতা নেই। পুলিশ প্রভাবিত হয়ে আসামিদের ধরছে না।

শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, মামলার প্রধান আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্য দুই আসামি পলাতক। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।