তালাবদ্ধ ঘর থেকে‌ গায়েব অর্ধকোটি টাকার যন্ত্র

বাগেরহাটের রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র
ছবি: প্রথম আলো

চুরির ঘটনা যেন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাগেরহাটের রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে। এত দিন মূল উৎপাদনকেন্দ্রের বাইরের বিভিন্ন মালামাল চুরির ঘটনা ঘটলেও এবার কেন্দ্রের ভেতরে তালাবদ্ধ ঘর থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার একটি যন্ত্র চুরির ঘটনা ঘটেছে।

এ চুরির ঘটনায় করা মামলায় আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা জানান, চুরির ঘটনাস্থলে কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ কর্মী ও কর্মকর্তা ছাড়া বাইরের কারও প্রবেশ সম্ভব নয়।

তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, ১৫ জানুয়ারি সকালে তালাবদ্ধ কয়লা টেস্টিং ল্যাব-২–এর দরজার নিচ দিয়ে পানি বের হতে দেখেন দায়িত্বরত কর্মীরা। পরে টেস্টিং ল্যাব খুলে পানি পরিষ্কারের পর দেখা যায় টেবিলের ওপর কয়লার দাহ্য ক্ষমতা পরীক্ষার যন্ত্রটি নেই। পরে এ ঘটনায় কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও নিরাপত্তা) মো. অলিউল্লাহ বাদী হয়ে রামপাল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় আমেরিকায় তৈরি ‘বোম্ব ক্যালরিমিটার’ নামে যন্ত্রটির দাম উল্লেখ করা হয়েছে আনুমানিক ৪৭ লাখ টাকা।

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যা ছয়টায় কেন্দ্রের কনিষ্ঠ সহকারী ব্যবস্থাপক (রসায়নবিদ) আবদুল মালেক ল্যাব বন্ধ করার সময় দেখে যান টেস্টিং যন্ত্রটি টেবিলের ওপরেই ছিল। আবদুল মালেক চলে যাওয়ার আগে তালার চাবি ল্যাব-১–এর মুসা পারভেজকে দিয়ে ল্যাব টেকনিশিয়ান সাদ্দাম হোসেন ও তানভীর রহমানকে দিয়ে যান। রাত ১০টায় ওই স্থানে দায়িত্বে (ডিউটি) আসেন জাকারিয়া আল রাজী ও মাসুম বিল্লাহ। ১৫ জানুয়ারি সকাল সাতটায় তাঁদের কাজের সময় শেষ হয়। পরে সাদ্দাম হোসেন ও মাসুম বিল্লাহ দায়িত্ব নেন। সকাল ৯টার দিকে ক্লিনার আবদুল নোমান ল্যাব-২ পরিষ্কার করতে এসে টেবিলে যন্ত্র দেখতে না পেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান।

এ বিষয়ে মামলার বাদী অলিউল্লাহ বলেন, ‘চুরির ঘটনায় আমরা মামলা করেছি, কাজ চলছে।’ চুরির সময় নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করলেও সন্দেহভাজনের তালিকায় তাঁদের নাম না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে জবাব এড়িয়ে যান বাদী। এ ছাড়া ওই রাতে যাঁরা দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের বিষয়ে এবং সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘আমি কিছু জানি না’ বলে মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন অলিউল্লাহ।

রামপাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শামসুদ্দিন বলেন, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার দাহ্য ক্ষমতা পরীক্ষার যন্ত্র চুরির ঘটনায় তদন্ত চলমান রয়েছে। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে। তবে তদন্তের স্বার্থে বেশি কিছু বলতে তিনি রাজি হননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, কয়লার দাহ্য ক্ষমতা পরীক্ষার যন্ত্র সাধারণ মানুষের কোনো কাজে লাগার কথা নয়। তাই ছিঁচকে চোরদের চুরি করারও কথা নয়। বড় কোনো চক্র এবং কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ কেউ এতে জড়িত বলে ধারণা তাঁর। ল্যাব এলাকায় রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার জন্য লোক থাকা সত্ত্বেও মামলায় কারও নাম না দেওয়ার বিষয়টি কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায় এড়ানোর চেষ্টা বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে দায়িত্বরত আনসার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক চন্দন দেবনাথ বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বাইরের চুরি অনেকাংশে কমেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিষয়টি মূলত কেন্দ্র কর্তৃপক্ষই দেখে। এখানে আমাদের খুব বেশি কিছু করার সুযোগ নেই।’

নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ মাসে র‌্যাব-৬–এর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে চোরচক্রের ২০ জনকে আটক ও অর্ধকোটি টাকার মালামাল উদ্ধার করে। অপরদিকে গত ৯ মাসে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে দায়িত্বরত আনসার ব্যাটালিয়ন খুলনার সদস্যরা ৩৩ জন চোরকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় চোরাইকৃত ৫৩ লাখ টাকার মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে।

ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির (এনটিপিসি) সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট (পিডিবি) বোর্ড ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৯১৫ একর জায়গার মধ্যে ৪৫০ একর জায়গায় দেয়ালবেষ্টিত সীমানাপ্রাচীর রয়েছে। এই প্রাচীরে ৯টি ফটক। এর বাইরে প্রায় দুই কিলোমিটার নদীর সীমানাসহ বাকি জায়গা প্রায় অরক্ষিত।

গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর প্রথম ইউনিটের উৎপাদনে যায় কেন্দ্রটি। উৎপাদনে যাওয়ার ২০-২২ দিন পরেই আমদানিকৃত কয়লার স্বাভাবিক মজুত শেষ হয়ে যায়। ডলার–সংকটে ঋণপত্র খুলতে না পারায় রিজার্ভ কয়লা দিয়ে আরও পাঁচ দিন উৎপাদন চালু রাখা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ঋণপত্র খোলার বিষয়ে আলোচনা করেও সমাধান না হওয়ায় কয়লা আমদানি করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে রিজার্ভ কয়লার মজুতও শেষ হয়ে যায়। ফলে ১৪ জানুয়ারি সকালে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর মাত্র ২৭ দিনের মাথায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার প্রথম ইউনিটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।