বর্ষাকালে যেন সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসেছে কিশোরগঞ্জের হাওরগুলো। সেই সৌন্দর্যের টানে হাওরবেষ্টিত উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীতে ছুটে আসছেন ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা। উপভোগ করছেন হাওরের বিস্তৃত জলরাশি।
আবার হাওরের নয়নকাড়া সৌন্দর্যের টানে ঘুরতে এসে ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও। সাঁতার না জানার পর পানিতে গোসল করতে নেমে প্রাণহানিও ঘটছে। বর্ষায় হাওরে নতুন পানি আসার পর থেকে গত এক সপ্তাহে অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ৪ জুলাই (মঙ্গলবার) করিমগঞ্জে এক বন্ধুর বিয়েতে এসে হাওরের পানিতে ডুবে দুই বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার গুণধর উচ্চবিদ্যালয়ের দক্ষিণে বড় হাওরে পাঁচ বন্ধু মিলে গোসল করতে গেলে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। একই দিন কুলিয়ারচর ও কটিয়াদিতে পানিতে ডুবে আরও দুই তরুণের মৃত্যু হয়। এর আগে গত বছর বর্ষার সময় হাওরের পানিতে শিশু, পর্যটকসহ অন্তত ২০ জনের মতো মানুষ মারা গেছে। অসাবধানতা ও সাঁতার না জানার কারণে মৃত্যুর এ মিছিল বলে মন্তব্য স্থানীয় লোকজনের। ২০২১ সালের বর্ষাতেও হাওরে ডুবে ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলা সদরকে বর্ষার প্রচণ্ড ঢেউয়ের কবল থেকে রক্ষায় পাঁচ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়েছে। ভাঙনপ্রবণ উপজেলার ছাতিরচর গ্রাম রক্ষায় রোপণ করা হয় হাজার হাজার করচগাছ। সাগরের মতো দিগন্তবিস্তৃত জলরাশির মধ্যে দৃষ্টিনন্দন এ বেড়িবাঁধ ও ভাসমান পানিসহিষ্ণু করচবনের রূপ দেখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পর্যটকেরা আসছেন।
সরেজমিন নিকলী বেড়িবাঁধ এলাকায় দেখা যায়, পর্যটক আসার অপেক্ষায় ঘাটে নৌকা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বন্ধু ও পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুরতে এসেছেন অনেকে। পর্যটকদের কেউ কেউ টায়ার-টিউব নিয়ে হাওরের পানিতে নেমে জলকেলি করছেন। কেউ নৌকা ও স্পিডবোটে দিগন্তবিস্তৃত জলরাশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পাশাপাশি বিস্তীর্ণ হাওরের বুকে ভাসমান করচবনের শীতল ছায়ায় প্রিয়জনদের নিয়ে মেতে উঠছেন উল্লাসে।
নিকলীর স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল রানা, মোহাম্মদ শামীমসহ কয়েকজন বলেন, হাওরবেষ্টিত উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ ও নিকলীতে বেড়িবাঁধসহ কয়েকটি সেতু রয়েছে। এ ছাড়া হাওরের বুক চিরে তৈরি করা হয়েছে নয়নকাড়া রাস্তা। এসব সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসুদের টেনে আনছে হাওরে। এখানে এসে অনেক পর্যটক হাওর দেখার পাশাপাশি ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার ও গোসলে নামেন। অনেকে নৌকায় দল বেঁধে ঘুরতে বের হন। এ সময় অনেকে নিরাপত্তার কথা ভুলে যান। অসাবধানতা ও সাঁতার না জানার কারণে সৌন্দর্য দেখতে এসে লাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। যদি পর্যটকেরা সতর্ক থাকেন, তাহলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে।
নিকলীর কারপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাকি আমান খান বলেন, এখন বর্ষার মৌসুম। পানি আসায় পর্যটকেরাও আসছেন। শুক্রবার ও শনিবার ছুটির দিনে নিকলী হাওর পর্যটন এলাকা পর্যটকে ভরপুর থাকে। তবে সবাই যেন পানিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে সতর্ক থাকেন। কারণ, সাময়িক আনন্দ–বিনোদনের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
সাঁতার জানলেও স্রোতে যেন কেউ গোসল করতে না নামেন, সে ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকার ওপর জোর দিলেন কিশোরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের জ্যেষ্ঠ স্টেশন কর্মকর্তা আবুজর গিফারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষায় কিশোরগঞ্জের হাওর ঘিরে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এবার সাঁতার না জানা সত্ত্বেও পানিতে নামায় কয়েকজন পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে। সেটা খুবই দুঃখজনক। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে। তবে সবাইকে আরও সতর্ক থাকা উচিত। পাশাপাশি পানিতে বেড়াতে গেলে অবশ্যই যেন লাইফ জ্যাকেট পরে নেন সবাই।
বেড়াতে এসে মূল্যবান প্রাণ ঝরে পড়ুক, এটা কারও কাম্য নয় উল্লেখ করে কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বিবেচনায় নিয়ে হাওরঅধ্যুষিত করিমগঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীর নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যেসব জায়গা বিপজ্জনক, সেসব জায়গায় সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড স্থাপনের পাশাপাশি নৌকায় ভ্রমণ ও পানিতে গোসলের বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া হাওরের মাঝে যেন কেউ রাত্রীযাপন না করেন এবং সন্ধ্যার আগেই যেন হাওর থেকে নিরাপদ জায়গায় উঠে আসেন, সে বিষয়েও সতর্ক করা হচ্ছে।