চাকরিজীবী সুজন তঞ্চঙ্গ্যা (২৬) অফিস থেকে বাসায় আসা–যাওয়ার জন্য সাধারণত চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করেন। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে তিনটা। লালখান বাজার থেকে মোটরসাইকেলে করে নগরের পতেঙ্গার দিকে রওনা হন তিনি। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের আগ্রাবাদ এলাকা অতিক্রম করার পর হঠাৎ গাড়ি থেকে পড়ে যান সুজন। এরপর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
কীভাবে মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গেলেন, জানতে চাইলে সুজন তঞ্চঙ্গ্যা এই প্রতিবেদককে বলেন, চিকন নাইলনের সুতা গলায় লেগে তিনি গাড়ি থেকে পড়ে যান। পড়ে যাওয়ার পর গলায় হাত দিয়ে দেখেন, অল্প অল্প রক্ত ঝরছে। নাইলনের চিকন সুতাটি তখনো তাঁর গলায় বেঁধে ছিল। দূর থেকে তিনি দেখতে পাননি। তাঁর ধারণা, সুতাটি আগে থেকে উড়ালসড়কের এক পাশে বেঁধে রাখা হয়েছিল। তিনি কাছাকাছি আসার পর আরেক পাশে বেঁধে টাঙিয়ে দেওয়া হয়। গলায় সুতা পেঁচিয়ে মারাও যেতে পারতেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
সুজন তঞ্চঙ্গ্যার সঙ্গে মোটরসাইকেলে উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা নামের তাঁর এক বন্ধু ছিলেন। তিনি জানান, হঠাৎ বাইক থেকে পড়ে গিয়ে তিনি নিজেও আহত হন। তখন তাঁরা আশপাশে কয়েকজন কিশোরকে দেখেছেন। তবে এ সময় বেশ কিছু গাড়ি থেমে যাওয়ায় কিশোরেরা সেখান থেকে চলে যায়। তাঁরা নিজেরা আহত হওয়ায় কিশোরদের বিষয়ে বেশ কিছু জানার সুযোগ পাননি।
চট্টগ্রাম নগরে উঠতি ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও এমন অভিনব কৌশলে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ছিনতাইয়ের অন্যতম স্পট হিসেবে আলোচিত হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
ভুক্তভোগী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যারা ছিনতাইয়ে জড়িত, তাদের বেশির ভাগই মাদকাসক্ত এবং উঠতি বয়সের ছিনতাইকারী। দেড় মাস ধরে এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। তবে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা কিংবা অভিযোগ না করায় তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। ছবি তোলা কিংবা দল বেঁধে ঘোরার ভান করে এরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অবস্থান নেয়। যখন গাড়ি চলাচল কম থাকে, তখনই মোটরসাইকেল আরোহীদের নিশানা করে তারা।
চাকরিজীবী সুজন তঞ্চঙ্গ্যার ঘটনার আগে ১৮ অক্টোবর একইভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ঘটনার শিকার হন সাইদুর রহমান নামের আরেক চাকরিজীবী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সেদিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা থেকে ওঠেন লালখান বাজার আসার জন্য। কিছু দূর আসার পর পতেঙ্গা মহাজনঘাটা এলাকায় ধারালো সুতা গলায় আটকে পড়ে আহত হন তিনি। তিনিও ওই সময় আশপাশে কয়েকজন কিশোরকে দেখেছেন। আশপাশে যানবাহন থাকায় তিনি ছিনতাইয়ের হাত থেকে বেঁচে যান। এ ঘটনায় তিনি কোনো মামলা করেননি।
একইভাবে ভুক্তভোগী সুজন তঞ্চঙ্গ্যাও কোনো মামলা করেননি। কেন, জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যথায় কাতরাচ্ছি। সুস্থ হলে মামলা করতে পারি। তবে মামলা করেও কিছু হবে না ভেবে মামলা করছি না।’ সুজন তঞ্চঙ্গ্যা আহত হওয়ার পর ফেসবুকে ঘটনার বিবরণ দিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এরপর তাঁর সঙ্গে এ রকম অনেক ভুক্তভোগী যোগাযোগ করে এমন ঘটনার কথা জানিয়েছেন।
আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সাড়ে ৯ মাস পর গত ২৮ আগস্ট পরীক্ষামূলকভাবে গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে চট্টগ্রাম নগরের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে। নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এটি ১৬ কিলোমিটার। এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারে টোল দিতে হবে। তবে পরীক্ষামূলক গাড়ি চলাচলে কোনো টোল নেওয়া হচ্ছে না। এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের (মূল উড়ালসড়ক থেকে ওঠানামার পথ) কাজ শেষ না হওয়ায় গাড়িগুলো নগরের লালখান বাজার থেকে সরাসরি পতেঙ্গা পর্যন্ত যাতায়াত করছে। গত বছরের ১৪ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরের ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে’–এর উদ্বোধন করেছিলেন। ২০২০ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দুই দফা সময় বৃদ্ধি করে মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। এই সময়ে প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকায়।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সুতা বেঁধে ছিনতাইয়ের চেষ্টার খবর জানতে পেরে পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে বলে জানান নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) কাজী মো. তারেক আজিজ। আজ তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভুক্তভোগীরা মামলা করলে ঘটনায় জড়িতদের সহজে শনাক্ত করা যেত। ছিনতাইয়ের ঘটনার শিকার হলেও ভুক্তভোগীরা মামলা বা পুলিশের শরণাপন্ন হচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘মামলা না করার পেছনে পুলিশের প্রতি অনাস্থার বিষয় নেই। সচেতনতার অভাবই মূল কারণ।’