বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের মহুবার হোসেন একসময় মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। ঢাকায় এসে রিকশাও চালিয়েছেন।
একসময় অন্যের বাড়িতে পেটেভাতে কাজ করেছেন মহুবার হোসেন (৪৭)। তিনি অনেক বাধা পেরিয়ে পরিশ্রম ও বুদ্ধির জোরে হাঁসের খামার গড়ে এখন মাসে লাখ টাকার ওপরে আয় করছেন। হাঁসের খামার দিয়ে তাঁর সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।
মহুবার হোসেনের বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের চম্পাতলী চাকলাপাড়া গ্রামে। গত সোমবার হাঁসের খামারে কথা হয় মহুবার হোসেনের সঙ্গে।
দারিদ্র্যজয়ী মহুবার হোসেন তাঁর জীবনের ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলতে গিয়ে বলেন, অতিদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ৯ ভাইবোনের মধ্যে ছিলেন চতুর্থ। তখন তাঁর বাবার সংসারে অভাব ছিল প্রকট। খেয়ে না-খেয়ে দিন চলত সবার। মাত্র ১০ বছর বয়সে মহুবার হোসেনের বাবা হযরত আলী মারা যান। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মারা যাওয়ায় তাঁরা অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হতেন। বাধ্য হয়ে পেটেভাতে চুক্তিতে প্রতিবেশী একজনের বাড়িতে কাজ করেন। বছর দুয়েক সেখানে ওই চুক্তিতেই কাজ করেন। পরের এক বছরের জন্য চুক্তি হয় পেটেভাতেসহ সঙ্গে ৩০০ টাকা। তবে সেখানে তাঁকে প্রায়ই লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হতো।
বাধ্য হয়ে সেখান থেকে বের হয়ে মহুবার হোসেন ধান ছেঁটে গ্রামে ভ্রাম্যমাণ চালের ব্যবসা করেন। অন্তত চার বছর এই ব্যবসা করার পর বেশ কিছু টাকা লোকসান গোনেন। তিনি মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে চালের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। চালের ব্যবসা করার সময় তিনি বিয়েও করে ফেলেন।
চালের ব্যবসায় লোকসান হওয়ার পর পাওনাদারেরা তাঁকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন। ব্যবসায় তাঁর লোকসানের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত চার লাখ টাকা। পুঁজি হারিয়ে এবং পাওনাদারের চাপে ২০০৯ সালে তিনি রাতের অন্ধকারে স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমান।
মহুবার জানান, ঢাকায় গিয়ে প্রথমে কোনো কাজ না পেয়ে বেকায়দায় পড়েন। পরে স্ত্রী মরিয়ম বেগমের পোশাক কারখানায় চাকরি জোটে। দুই ছেলেসন্তানকে রাখেন ঢাকা সদরঘাটের একটি দরজির দোকানে। তিনি নিজে ঢাকায় চালানো শুরু করেন রিকশা।
মহুবার, তাঁর স্ত্রী, দুই ছেলে ঢাকায় নানা ধরনের কাজ করে আয় করতে শুরু করেন। মহুবার পরে তাঁদের আয়ের টাকা দিয়ে পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধ করেও কিছু সঞ্চয় করতে শুরু করেন। সঞ্চয়ের প্রায় সাত লাখ টাকা দিয়ে গ্রামে টিনশেডে ভবন করেন। ২০২০ সালে করোনার কারণে ঢাকায় সপরিবার কর্মহীন হয়ে পড়েন। এতে সংসার পরিচালনায় পুনরায় টান পড়া শুরু হয়।
বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন। করোনায় নিষেধাজ্ঞার কারণে ওই সময়ে গ্রামের বাড়ি থেকে বের হওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সংসার পরিচালনার দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটতে থাকে মহুবারের। সংসার চালানোর জন্য ভালো আয় হয়, এমন কিছু করার চিন্তা করতে থাকেন। ঠিক তখনই তাঁর মাথায় হাঁস পালনের কথা আসে। বাড়ির পাশে ১৮ শতক পুকুর ইজারা নিয়ে ৫০০ বাচ্চা কিনে শুরু করেন হাঁস পালন। পুকুরপাড়ে তৈরি করেন হাঁসের ঘর।
মহুবার হোসেন বলেন, বর্তমানে তাঁর খামারে হাঁস রয়েছে এক হাজার। এর মধ্যে গড়ে প্রতিদিন ডিম দিচ্ছে ৫০০ হাঁস। ৭০ টাকা হালি হিসেবে বাড়ি থেকেই ওই ডিম বিক্রি করছেন তিনি।
মহুবার হোসেন জানান, খাদ্যসহ সব মিলিয়ে হাঁসের পেছনে দৈনিক খরচ চার হাজার টাকা। ৫০০ ডিম বিক্রি করে প্রতিদিন পাচ্ছেন ৮ হাজার ৭৫০ টাকা। এতে দেখা যায়, যাবতীয় খরচ বাদে মাসে ডিম বিক্রি করেই তিনি বর্তমানে দৈনিক আয় করছেন ৪ হাজার ৫৫০ টাকা। এতে মাসিক লাভের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ টাকা।
বদরগঞ্জ প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের উপসহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আবদুল কাদের বলেন, ‘হাঁসের খামার গড়ে মহুবার হোসেনের সফলতার বিষয়টি আমরা জানি। এসব কাজে আমরা সব সময় উৎসাহিত করাসহ পরামর্শ দিয়ে থাকি।’