রেলওয়ের জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুদানে নিজ গ্রামে মায়ের নামে হাসপাতাল নির্মাণ করছেন মন্ত্রী।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ সম্প্রতি নিজ গ্রামে রেলওয়ের জমিতে অবৈধভাবে একটি সংগঠনের সম্প্রসারিত ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। ‘অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী’ নামের সংগঠনটি পরিচালনা করেন মন্ত্রীর স্বজনেরা। এ ছাড়া নিজের নামে ইজারা নেওয়া রেলওয়ের ৩৬ শতক জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে তাঁর ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদ পার্ক ও সুইমিংপুল নির্মাণ করেছেন। পার্ক নির্মাণের সময় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কাজ বন্ধ করে দিলেও প্রভাব খাটিয়ে কাজ শেষ করেন তিনি।
নুরুজ্জামান আহমেদ লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য। তিনি ২০১৬ সালের ১৯ জুন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ২০১৯ সালে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন।
এসব বিষয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভাণ্ডার ইউনিয়নের কাশিরামে সমাজকল্যাণমন্ত্রীর নিজ বাসভবনে কথা হয় প্রথম আলোর। এ সময় নির্বাচনী এলাকার অনেক মানুষ ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য সেখানে উপস্থিত ছিলেন। নুরুজ্জামান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রেলওয়ের কাছ থেকে ইজারা নেওয়া জমিতে তাঁর ছেলে জনস্বার্থে পার্ক ও সুইমিংপুল নির্মাণ করেছে। কৃষিজমি হিসেবে ইজারা নেওয়া জমিতে অবকাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে তিনি বলেন, দরকার হলে সেই অনুমোদন নেওয়া হবে। মন্ত্রী বলেন, ‘এলাকায় আমার গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি মহল থেকে ভুল তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এতে আমি চিন্তিত নই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার ভালো কাজের বিষয়ে অবগত আছেন।’
রেলওয়ের জমিতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুদানে নিজ গ্রামে ৪৪ কোটি টাকা ব্যয়ে মায়ের নামে হাসপাতাল নির্মাণ করছেন মন্ত্রী। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করছে মন্ত্রীর মায়ের নামের এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) করিমপুর নূরজাহান-সামসুন্নাহার উন্নয়ন সংস্থা। নির্মাণকাজ পেয়েছে মন্ত্রীর ভাইয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
চলতি বছরের ১৮ আগস্ট কালীগঞ্জ উপজেলার তুষভান্ডার ইউনিয়নের কাশীরাম মৌজায় রেলস্টেশনের পূর্ব দিকে ‘অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর’ সম্প্রসারিত ভবন ও পাঠাগারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। লালমনিরহাট রেলওয়ের বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা পূর্ণেন্দু দেব বলেন, রেলস্টেশনের পূর্ব দিকে রেলওয়ের জমি কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি। রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগ থেকে কাউকে অনুমোদনও দেওয়া হয়নি। সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করলে সেটি অবৈধ স্থাপনা হিসেবে গণ্য হবে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতি মন্ত্রীর বৈমাত্রেয় ভাই খুরশিদুজ্জামান আহমেদ। সাধারণ সম্পাদক মন্ত্রীর ছেলে ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুজ্জামান আহমেদ। সদস্য হিসেবে আছেন মন্ত্রীর আরেক সৎভাই ওয়াহেদুজ্জামান আহমেদ, তাঁর স্ত্রী নীলা জামান, রাকিবুজ্জামান আহমেদের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসী ও খুরশিদুজ্জামান আহমেদের স্ত্রী রুমি বেগম।
গত ৫ সেপ্টেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জহির ইমামকে একটি ডিও লেটার দেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী। এতে উল্লেখ করা হয়, কালীগঞ্জ উপজেলায় জনস্বার্থে এডিবির আওতাভুক্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। পত্রে উল্লিখিত পাঁচটি প্রকল্পের মধ্যে ১ নম্বরে অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সম্প্রসারিত ভবন ও লাইব্রেরি বাস্তবায়নের কথা আছে।
ইউএনও জহির ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রীর ডিও লেটারটি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের নির্দেশনার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতির কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ভবন সম্প্রসারণে রেলওয়ের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না। কিন্তু তিনি কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।
অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতি খুরশীদুজ্জামান আহমেদ ভবন সম্প্রসারণে রেল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন বা জমি ইজারা না নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। এ ব্যাপারে রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উদ্যোগে বিভিন্ন সময় সার্কাস, যাত্রা, খেলাধুলা, গানের অনুষ্ঠানের পাশাপাশি অন্যান্য জাতীয় দিবস পালন করা হয়। ২০২৩ সালে সংগঠনটির সবচেয়ে বড় আয়োজন ছিল ২৮ এপ্রিল রাতে রাকিবুজ্জামান আহমেদের একক সংগীতানুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নুরুজ্জামান আহমেদ ও বিশেষ অতিথি ছিলেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান।
গত ২৯ আগস্ট নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) কালীগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী রকি চন্দ্র দাসকে মন্ত্রীর ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদের সঙ্গে অন্বেষার কার্যালয়ে দেখা করতে বলে ফোন করেন ছাত্রলীগের স্থানীয় এক নেতা। ওই প্রকৌশলী সেই ডাকে সাড়া দেননি। এরপর ওই প্রকৌশলীর কার্যালয়ে হামলা-ভাঙচুর করা হয়। এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলার অজুহাত ওই প্রকৌশলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনার পর মন্ত্রীর পরিবারের বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের বিষয়টি জানাজানি হয়।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত মন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের চারটি মিটারে প্রায় ৯ লাখ টাকার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়ে। মাসের পর মাস বিল পরিশোধ না করা হলেও নেসকো সংযোগ বিচ্ছিন্ন বা মামলা করেনি। এ নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিল পরিশোধ করা হয়।
তুষভান্ডার রেলস্টেশনের পশ্চিমে বৈরাতী মৌজায় রেলওয়ের ৪০ শতক কৃষিজমি আছে। সেখান থেকে ৩৬ শতক জমি ইজারা নিয়েছিলেন মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ। শর্তানুযায়ী কৃষিজমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু অবৈধভাবে ওই জমিতে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পার্ক ও সুইমিংপুল নির্মাণ করেছেন রাকিবুজ্জামান আহমেদ। পার্ক নির্মাণের সময় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু নির্মাণকাজ শেষ করেন রাকিবুজ্জামান।
রেলওয়ের ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা পূর্ণেন্দু দেব বলেন, বৈরাতী মৌজায় মন্ত্রীর নামে ইজারা নেওয়া কৃষিজমিতে সীমানাপ্রাচীরসহ পার্ক ও সুইমিংপুল নির্মাণ করা হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু অল্প কয়েক দিনের মধ্যে তিনি কাজ শেষ করেন। তিনি বলেন, ইজারার জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করায় বার্ষিক ইজারার টাকা গ্রহণ থেকে বিরত আছে রেলওয়ে ভূসম্পত্তি বিভাগ।
এ বিষয়ে মন্ত্রীর ছেলে রাকিবুজ্জামান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেলস্টেশন এলাকায় যে জমিতে পার্ক ও সুইমিংপুল নির্মাণ করেছি, সেই জমি আমার বাবার নামে লিজ (ইজারা) নেওয়া হয়েছে। এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন ও জনস্বার্থে পার্ক ও সুইমিংপুল নির্মাণ করেছি।’ কৃষিজমির শ্রেণি পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
নুরুজ্জামান আহমেদের গ্রামে তাঁর মায়ের নামে ‘করিমপুর নূরজাহান-সামসুন্নাহার মা ও শিশু বিশেষায়িত হাসপাতাল’ নির্মিত হচ্ছে। পাঁচতলা ভবনের ওই হাসপাতাল নির্মাণের ৮০ শতাংশ অর্থ বা ৩৫ কোটি টাকা দিয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর, যেটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন। হাসপাতালের ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে মন্ত্রীর ভাই শামসুজ্জামান আহমেদের প্রতিষ্ঠান দ্য বিল্ডার্স অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড। এ নিয়ে প্রথম আলোয় ‘করের টাকায় মন্ত্রী-সচিবের মা-বাবার নামে প্রতিষ্ঠান’ শিরোনামে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়।
হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করছে মন্ত্রীর মায়ের নামের এনজিও ‘করিমপুর নূরজাহান-সামসুন্নাহার উন্নয়ন সংস্থা’। মন্ত্রীর বাবা প্রয়াত করিমউদ্দিন আহমেদের দুই স্ত্রী সামসুন্নাহার করিম ও নূরজাহান করিমের নামে হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প পাওয়া এনজিওটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারি সহযোগিতা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট খাতে ওই এনজিওর অন্তত দুই বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু নিবন্ধনের দেড় বছর পরেই হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প পায় মন্ত্রীর মায়ের নামের ওই সংস্থা।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক শামসুজ্জামান আহমেদ বলেন, ইতিমধ্যে হাসপাতালের পাঁচতলার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন ভবনের রঙের কাজসহ আনুষঙ্গিক কাজ বাকি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে হাসপাতালটি হস্তান্তরের জোর চেষ্টা চলছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী বছরের জুন মাসের আগে সংস্থার অনুদানের বাকি টাকা জমা দেওয়া হবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুদানে হাসপাতাল নির্মাণের নিয়ম হলো, শহর এলাকায় প্রকল্প করতে মোট ব্যয়ের ৬০ শতাংশ ও গ্রাম এলাকায় ৮০ শতাংশ অর্থ সরকার দেবে, বাকিটা দেবে এনজিও। হাসপাতালটি নির্মাণে মোট ব্যয়ের ২০ শতাংশ এনজিওর দেওয়ার কথা। এনজিওর অংশ বাবদ মন্ত্রীর পরিবারের দেওয়া এক একর জমির দাম দেখানো হয়েছে সাড়ে ৫ কোটি টাকা। স্থানীয় সাব–রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের তথ্যমতে, ওই জমির দাম হওয়ার কথা ৫২ লাখ টাকা। বাকি টাকা হাসপাতাল নির্মাণের হিসাবে জমা পড়েনি। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদনে ওই টাকা দ্রুত জমা করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।