বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের পেছনে রাখাইন রাজ্যের পাহাড়ে গোলাগুলি শুরু হলে ধানখেত ছেড়ে পালাতে থাকে এক শিশু
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের পেছনে রাখাইন রাজ্যের পাহাড়ে গোলাগুলি শুরু হলে ধানখেত ছেড়ে পালাতে থাকে এক শিশু

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত

মিয়ানমার বাহিনীর গুলির শব্দে ঘুম ভাঙছে এপারের বাসিন্দাদের

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড়ে গোলাগুলি চলছেই। আজ রোববার সকাল ছয়টা থেকে গোলাগুলি শুরু হয়। দুপুর ১২টার দিকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মুহুর্মুহু গুলি ও মর্টার শেল ছোড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। গোলাগুলির ব্যাপকতা বেড়ে যাওয়ায় শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরের চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা এবং এপারের ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকার কয়েক হাজার বাসিন্দার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

তুমব্রু এলাকার বাসিন্দা ও ঘুমধুম ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারে গোলাগুলির বিকট শব্দে এপারের মানুষের ঘুম ভাঙছে। এক মাসের বেশি সময় ধরে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে জীবন যাপন করতে হচ্ছে ঘুমধুমের মানুষকে। ছাত্রছাত্রীরা ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। সীমান্ত এলাকার চাষাবাদও প্রায় বন্ধ। সীমান্তে গোলাগুলি বন্ধে বাংলাদেশ কড়া প্রতিবাদ জানালেও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সাড়া মিলছে না।

গত শুক্রবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি ভারী অস্ত্রের গুলি তুমব্রু বাজারের পাশে কোনারপাড়ার কৃষক শাহজাহানের বাড়ির আঙিনায় এসে পড়েছিল। বাড়ির পাশেই শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। এর আগেও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল এসে পড়ে। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হেলিকপ্টার ও ফাইটার জেট বাংলাদেশের আকাশসীমায় ঢুকে পড়ে বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

গতকাল রাজধানীতে বিসিআইপিএ আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, সীমান্তবর্তী এলাকায় মিয়ানমারের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকির চেয়ে কম নয়। মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের গোলা এসে পড়ছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। এ কারণে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন ও অপরাধ।

আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা, ঘুমধুমের জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের লাগোয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং পাহাড় ও খ্য ম্য সেক পাহাড়ে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) তুমুল লড়াই চলছে। প্রথম তিন সপ্তাহ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওপারে গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসত। এর মধ্যে দুই দফায় মিয়ানমার বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়ে। শুক্রবার থেকে গোলাগুলির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এতে হাজারো কৃষকের চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকেরা বলেন, গোলাগুলির ঘটনায় তাঁরা খেতে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। ঘুমধুম ও নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের অন্তত ৯০০ একর ধান, জুম ও শাকসবজির আবাদের জমি পড়েছে মিয়ানমার সীমান্তসংলগ্ন এলাকায়।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকাল সাতটা থেকে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু করছে দুই পক্ষ। থেমে থেমে ছোড়া হচ্ছে মর্টার শেলও। গোলাগুলির বিকট শব্দে তুমব্রু সীমান্ত কাঁপছে।
ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টু বলেন, মিয়ানমারে গোলাগুলির ঠিক ঠিকানা নেই। আগে সকাল ৯টার দিকে গোলাগুলি শুরু হতো, দুপুর ১২টা থেকে দেড়টার মধ্যে থেমে যেত। গত কয়েক দিন গোলাগুলি শুরু হয় বিকেলের দিকে। এখন চলছে ভোর থেকে। গোলাগুলির কোনো নির্দিষ্ট সময় না থাকায় এপারের বাংলাদেশিরা সব সময়ই আতঙ্কে আছে।

রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং পাহাড়ের পাদদেশে শূন্যরেখায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবির। সেখানে পাঁচ বছর ধরে বাস করছে ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি (আইসিআরসি) শিবিরের রোহিঙ্গাদের খাবার ও ত্রাণসহায়তা দিয়ে আসছে।

শূন্যরেখার আশ্রয়শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকাল ছয়টার দিকে বিচ্ছিন্নভাবে গুলির শব্দ কানে এলেও সাতটার দিকে এর ব্যাপকতা বেড়ে যায়। সাতটা থেকে টানা সাত মিনিট অন্তত কয়েক হাজার গুলি ছোড়া হয়েছিল। এরপর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের জন্য গোলাগুলি থামে। তারপর আবার শুরু হয় ১০ থেকে ১৫ মিনিট টানা গোলাগুলি। এভাবে থেমে থেমে গোলাগুলির পাশাপাশি আর্টিলারি ও মর্টার শেল ছোড়া হচ্ছে। গোলাগুলির শব্দে রোহিঙ্গাদের ঘুম ভাঙছে। গভীর রাতেও তারা আতঙ্কে ঘুমাতে পারছে না।

নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পাহাড়ের চূড়ায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর একটি চৌকি। পাহাড়ের নিচে শূন্যরেখার চার হাজার রোহিঙ্গার আশ্রয়শিবির। চৌকি থেকে ছোড়া হয় গুলি

দিল মোহাম্মদ আরও বলেন, গোলাগুলির আতঙ্কে পাঁচ বছর আগে রাখাইন রাজ্যের বসতভিটা ছেড়ে তারা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শূন্যরেখার এই জায়গায় এসে আশ্রয়শিবিরটি গড়ে তুলেছিল। যখন সুযোগ হবে তখন এই আশ্রয়শিবির ছেড়ে রাখাইন রাজ্যে নিজেদের বাড়িতে ফেরার ইচ্ছা আছে তাদের। কিন্তু এক মাসের বেশি সময় ধরে ওই গোলাগুলির আতঙ্কেই তাদের দিন কাটাতে হচ্ছে। আশ্রয়শিবিরের পেছনের পাহাড়েই গোলাগুলি চলছে। আকাশে ফাইটার জেট ও হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া হচ্ছে বোমা, মর্টার শেল ও গুলি। কিছু মর্টার শেল ও গুলি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে গিয়ে পড়ছে। আশ্রয়শিবিরের ওপর একটি বোমা, মর্টার শেল কিংবা গুলি এসে পড়লে অনেকের প্রাণহানি ঘটতে পারে। কারণ, শিবিরে রোহিঙ্গাদের ঘনবসতি।

দিল মোহাম্মদের প্রশ্ন—যুদ্ধ করার মতো বহু পাহাড় রাখাইন রাজ্যের আশপাশে আছে, সেখানে যুদ্ধ না করে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি শূন্যরেখার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের কাছে কেন এত গোলাগুলি হচ্ছে, তা বোধগম্য হচ্ছে না। এর পেছনে অন্য রহস্য আছে কি না, তা ভাবতে হবে।

আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা জানায়, আজ সকাল থেকে আশ্রয়শিবিরের পেছনে ওয়ালিডং পাহাড়ের চৌকি থেকে যেভাবে গুলি ছোড়া হচ্ছে, তাতে মুখোমুখি যুদ্ধের আলামত দেখা যাচ্ছে না। একতরফা গুলি ছোড়া হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় যখন-তখন গুলি ছোড়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। আশ্রয়শিবিরের পেছনে ওয়ালিডং পাহাড়ে দুই দিন ধরে নিরাপত্তা বাড়িয়েছে মিয়ানমার। কাঁটাতারের বেড়ার পাশের জঙ্গলে সশস্ত্র বিজিপি সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে। পাহাড়ের চূড়া এবং খাদে তৈরি একাধিক চৌকিতে ভারী অস্ত্র নিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। ঘুমধুমের তুমব্রু বাজার থেকে মিয়ানমারের পাহাড়ের চৌকি ও নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান খালি চোখে দেখা যায়।