রাজশাহীর বাঘা সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির নামে অতিরিক্ত চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ছিল। পাঁচ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্যের এসএমএসে সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতেন। চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র দুই পক্ষের সংঘর্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খুন হলেও বন্ধ হয়নি চাঁদাবাজি। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর সেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের জায়গায় বসেছেন বিএনপির দুই নেতা।
সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন বাঘা উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান (জুয়েল) ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছেন উপজেলা জিয়া পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শাহীন মন্ডল। তবে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাইদ চাঁদ ঘোষণা দিয়েছেন, এগুলো করা যাবে না। একই ঘোষণা দিয়েছেন বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
দলিল লেখকেরা দাবি করেছেন, বাঘা সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ১৬০ জন দলিল লেখক আছেন। এর মধ্যে ১১০ জনই কোনো দলিল সম্পাদন করেন না। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, তাঁরা তাঁদের দলীয় লোকজনকে লাইসেন্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সমিতির মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে আদায় করা অর্থ থেকে তাঁদের ‘শেয়ার’ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক কারণে তাঁদের ভেতর থেকে নেতা নির্বাচিত হওয়ায় তাঁদের শেয়ারও বড় থাকে।
সর্বশেষ আওয়ামী লীগ থেকে সভাপতি ছিলেন বাঘা পৌর যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহীনুর রহমান (পিন্টু) ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন উপজেলার পাকুড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সামিউল আলম (নয়ন)। তাঁদের আগে সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন উপজেলা সৈনিক লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। তৎকালীন সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলমের এসএমএসের মাধ্যমে এই পরিবর্তন হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পর বিএনপির দুই নেতা সেই জায়গা দখল করেছেন।
তবে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাইদ চাঁদ বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, কোথাও চাঁদাবাজি, লুটপাট করা যাবে না। তিনি গত রোববার বাঘায় গিয়ে পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়ে এসেছেন, এগুলো করা যাবে না। করলে তাঁদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে।
পাঁচ বছর আগে দলিল লেখকদের ভোটে নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন জহুরুল ইসলাম। তাঁকে বাদ দিয়ে পাঁচ বছর ধরে সংসদ সদস্যের এসএমএসের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হচ্ছে। তাঁরা কেউ দলিল লিখতে জানেন না। কোনো দিন লেখেনওনি। শুধু কার্যালয়ে বসে টাকা আদায় করেছেন। বিএনপি থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁদেরও একই অবস্থা। সাধারণ দলিল লেখকেরা এটা চান না। তাঁরা ইউএনওর ঘোষণা অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান।
দলিল লেখকেরা জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পরে গত রোববার প্রথম কার্যদিবসে বিএনপির নেতারা সুবিধা করতে পারেননি। বেশির ভাগ দলিল লেখক তাঁদের চাঁদা দেননি। পরদিন সোমবার তাঁরা আওয়ামী লীগের আমলের মতোই টাকা আদায় করেছেন। খবর পেয়ে মঙ্গলবার সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে ইউএনও তরিকুল ইসলাম ঘোষণা দেন, দলিল লেখকেরা নিয়ম অনুযায়ী সরকারি ফি জমা দেবেন। একইভাবে তাঁদের পারিশ্রমিক নেবেন। এর বাইরে আর কোনো টাকা আদায় করা যাবে না। কিন্তু নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দায়িত্ব ছাড়েননি।
জানতে চাইলে সভাপতি মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, উন্মুক্তভাবে অফিস চললে দলিল লেখকদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তাঁরা খালি হাতে বাড়ি ফিরছেন। এ জন্যই তাঁরা সমিতিটা চালাতে চান। তাঁরা আওয়ামী লীগের মতো ডাকাতি করবেন না। শুধু দলিল লেখকদের যাতে কেউ লাঞ্ছিত করতে না পারেন, সে জন্য তাঁরা কাজ করবেন। এখন শুধু অফিস পরিচালনার জন্য ছয় থেকে সাত হাজার টাকা করে তুলছেন। পরে ইউএনও ও সাবরেজিস্ট্রারের সঙ্গে বসে কীভাবে সমিতি চালানো যায়, ঠিক করবেন।
সাধারণ সম্পাদক শাহীন মন্ডল বলেন, তিনি সমিতির পক্ষে। কারণ, সমিতি থাকলেই দলিল লেখকদের পেটের ভাত জুটবে। তবে তিনি আওয়ামী লীগের মতো ডাকাতি করার পক্ষে নন।
গত ২০ জুন সংসদ সদস্যের মনোনীত কমিটিবিরোধী দলিল লেখকেরা বাঘায় মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন ও পৌর মেয়র আক্কাস আলী। তাঁরা দলিল লেখকদের বাড়তি টাকা আদায় বন্ধের দাবি জানান। পরে ২২ জুন দলিল লেখক সমিতির দৌরাত্ম্য বন্ধের দাবিতে বাঘা উপজেলার সচেতন নাগরিকের ব্যানারে লায়েব উদ্দিন ও আক্কাছ আলীর সমর্থকেরা বিক্ষোভ মিছিল করেন।
পাল্টা কর্মসূচি হিসেবে একই দিন বাঘা পৌরসভার মেয়র আক্কাস আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে মানববন্ধনের ডাক দেয় উপজেলা আওয়ামী লীগ। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে দুই পক্ষের কর্মী-সমর্থকেরা উপজেলা চত্বরে জড়ো হলে তাঁদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে দুই পক্ষের অর্ধশতাধিক নেতা–কর্মী আহত হন। গুরুতর জখম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম বাবুলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চার দিন পর তিনি মারা যান।