‘শান্তির শহর’খ্যাত রাজশাহীতে গত কয়েক দিনে খুন–ছিনতাই বেড়েছে
‘শান্তির শহর’খ্যাত রাজশাহীতে গত কয়েক দিনে খুন–ছিনতাই বেড়েছে

শান্তির শহরে সন্ধ্যা নামলেই ‘অশান্তি’

এক রাতে দুটি বড় অঘটন ঘটে গেল রাজশাহী নগরে। দুজন খুন হলেন। তাঁদের একজন চিকিৎসক, অপরজন পল্লিচিকিৎসক। ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে জখম হলেন দুই ছাত্র। তাঁদের একজনের বুকে ৫০টি, অন্যজনের বুকে ৩০টি সেলাই দিতে হয়েছে। কয়েক দিন আগে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে খুন হন এক কলেজছাত্র।

একের পর এক ছিনতাই ও খুনের ঘটনায় রাজশাহী নগরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। শান্তির শহরখ্যাত রাজশাহীতে এখন সন্ধ্যা নামলেই ‘অশান্তি’ নেমে আসছে।

এমনই পরিস্থিতির মধ্যে রামদা, চাপাতি, চায়নিজ কুড়ালসহ নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একদল কিশোরের উল্লাস করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাজনার তালে তালে অস্ত্র উঁচিয়ে নাচানাচিও করছে কিশোরেরা। বলা হচ্ছে, অস্ত্র হাতে কিশোরদের উল্লাসের ভিডিওটি রাজশাহী নগরের শাহ মখদুম থানার গাংপাড়া এলাকার। যদিও পুলিশ বলছে, ভিডিওটি অন্তত চার মাসের পুরোনো। অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে কেউ ভিডিওটি ছড়িয়ে দিয়েছে।

দুই চিকিৎসককে খুন ও দুই ছাত্রকে জখমের ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এসব ঘটনার কোনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। এমনকি গত ৫ অক্টোবর নগরের কাটাখালী থানা এলাকায় এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করে ফাঁকা গুলি করে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। ২৫ দিন পার হলেও ওই ঘটনার কোনো সূত্র পায়নি পুলিশ। দুই চিকিৎসককে হত্যার সঙ্গে কাটাখালীর ওই হামলার মিল আছে। তিনটি ঘটনার ক্ষেত্রেই দুর্বৃত্তরা মাইক্রোবাস থেকে নেমেছে। দুটি জায়গায় তারা ফাঁকা গুলি করেছে। এসব ঘটনায় নগরবাসী আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

গত রোববার রাত নয়টার দিকে নগরের চন্দ্রিমা থানার কৃষ্টগঞ্জ বাজারে নিজ ফার্মেসি থেকে পল্লিচিকিৎসক এরশাদ আলীকে তুলে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এরশাদের ভাই নওশাদ আলী পাশের দোকান থেকে এগিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা গুলি ছুড়ে চলে যায়। এর তিন ঘণ্টা পর চিকিৎসক গোলাম কাজেম আলী পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে মোটরসাইকেলে নগরের উপশহরের বাসায় ফিরছিলেন। গ্লোবাল ফার্মা নামের একটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি শাহীনুজ্জামান তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। নগরের বর্ণালী মোড়ে একটি মাইক্রোবাস তাঁদের গতি রোধ করে চিকিৎসক গোলাম কাজেম আলীকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। মামলা হলেও এসব ঘটনায় এখনো কিনারা করতে পারেনি পুলিশ।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক গোলাম কাজেম আলী

এদিকে নগরের বেপরোয়া ছিনতাই শুরু হয়েছে। গত রোববার দিবাগত রাতে রাজশাহী রেলস্টেশনে ছিনতাইকারীদের হাতে দুই বন্ধু ছুরিকাহত হয়েছেন। আহত কৌশিক কুমারের বুকে ৫০টি ও অভিজিৎ কুমারের বুকে ৩০টি সেলাই দেওয়া হয়েছে। কৌশিক হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও অভিজিতের পরিবার তাঁকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছে। তাঁদের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায়। তাঁরা ভর্তির জন্য কোচিং করতে শহরে এসেছিলেন। এ ঘটনায় সোমবার রাতে কৌশিকের ফুফাতো ভাই রাজশাহী রেলওয়ে থানায় একটি মামলা করেছেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোপাল কর্মকার গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাই ও ছুরিকাঘাতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা যায়নি।

৫ অক্টোবর রাতে নগরের কাটাখালী থানার হরিয়ানে মো. শাহীন (৩৪) নামের এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। একটি মাইক্রোবাসে করে সন্ত্রাসীরা আসে। মুখোশধারী ব্যক্তিদের প্রকাশ্যেই শাহীনকে কোপাতে দেখে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে যান। এ সময় সন্ত্রাসীরা দুটি ফাঁকা গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়। ঘটনার পর শাহীনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল সন্ধ্যায় কাটাখালী থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ওই ঘটনায় সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে চিহ্নিত করা যায়নি।

এর আগে মহানগরের কাশিয়াডাঙ্গা থানার হড়গ্রাম মুন্সিপাড়া এলাকায় ১১ অক্টোবর মাহফুজুর হোসেন (৩৮) নামের এক যুবকের লাশ নিখোঁজের ১০ দিন পর তাঁর বন্ধুর বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়। মাহফুজুরকে ১ অক্টোবর অপহরণ করে ১ কোটি ও পরে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছিল।

১৭ সেপ্টেম্বর ভোরে ছিনতাইকারীর হামলায় আহত হন রাজশাহী কলেজের ছাত্র নিশাদ আকরাম (২৪)। তাঁর বাড়ি নওগাঁর নিয়ামতপুরে। তিনি রাজশাহী কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৬ দিন হাসপাতালে অচেতন থাকার পর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় নগরের বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা হয়েছে। পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে চেতনা না ফেরায় তাঁর কাছ থেকে ছিনতাইকারীদের সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি।

রাজশাহীতে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে বুকে ৫০টি সেলাই নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কৌশিক কুমার

২৬ অক্টোবর চলচ্চিত্র পরিচালক তৌকির ইসলাম ট্রেন থেকে নেমে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে নগরের ভদ্রা এলাকায় যাচ্ছিলেন। রেশম বোর্ডের সামনে তাঁর স্ত্রীর হাত থেকে ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। পরদিন নগরের বোয়ালিয়া থানায় তিনি একটি মামলা করেন। ব্যাগে মুঠোফোন ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছিল। একই এলাকায় ২৩ অক্টোবর তাহমিনা বেগম নামের এক নারীর ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ব্যাগে তাঁর মুঠোফোন ও স্বামীর পেনশনের গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিল।

এর আগে রাজশাহী মহানগর পুলিশ ১ হাজার ৫০০ কিশোর গ্যাংয়ের তথ্যভান্ডার তৈরি করেছিল, যারা প্রত্যক্ষভাবে ছিনতাইয়ে জড়িত। নগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ৪৫০ সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। এর মধ্যে প্রায় ১০০ ক্যামেরা নষ্ট হয়ে গেছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।

অস্ত্র নিয়ে কিশোরদের উল্লাসের ভিডিওর ব্যাপারে জানতে চাইলে শাহ মখদুম থানার ওসি ইসমাইল হোসেন বলেন, ওই কিশোর গ্যাং গ্রুপের এক ছেলের নাম আরাফাত। তাকে চার দিন আগে একই গ্রুপের অন্যরা মেরেছে। আরাফাত এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মারধরের কারণে তার পক্ষের কেউ ভিডিওটি ছেড়ে দিয়েছে। আরাফাতের অভিভাবক গত সোমবার থানায় অভিযোগ করতে এসেছিলেন। কিন্তু কারও নাম জানাতে পারেননি। মামলা হয়েছে। এখন কারা আরাফাতের ওপর হামলা করেছে ও চার মাস আগে কারা অস্ত্র হাতে উল্লাস করছিল—সবকিছুই বেরিয়ে আসবে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্র জানায়, গুরুতর আঘাতের কারণে আরাফাতের মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে। আইসিইউ ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, হাসপাতালে আনার পরই আরাফাতকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। তার অবস্থা সংকটাপন্ন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) রাজশাহীর সভাপতি আহমদ সফি উদ্দিন বলেন, ছয় মাস ধরে রাজশাহীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। সন্ধ্যার পর বাড়ি থেকে বের হতে গা ছমছম করে। তিনি বলেন, সুন্দর ও শান্তির শহর হিসেবে রাজশাহী উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল। এখন মনে হচ্ছে সেটা ভেঙে পড়ছে। আগে শহরকে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছিল, কিশোর গ্যাংয়ের ডেটাবেজ (তথ্যভান্ডার) তৈরি করা হয়েছিল। কোথাও কিছু হলে পুলিশের নজর এড়ানো যেত না। এখন এটা ভেঙে পড়ল। এ বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদেরও নজর দেওয়া দরকার। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি সবাই মিলে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো দরকার।

এ ব্যাপারে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তিনি ফোন ধরেননি। তবে মহানগর পুলিশের মুখপাত্র জামিরুল ইসলাম বলেন, পুলিশের ব্যবস্থাপনা ঠিকই আছে, ভেঙে পড়েনি। তাঁরা তৎপর আছেন। তবে ঘটনা ঘটেছে, অস্বীকার করার উপায় নেই। তাঁরা জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন।