স্ট্যান্ডের সঙ্গে একটি প্রতীকী মৌচাক ঝুলে আছে। তার নিচে হাত পাতলেই তালুভরে পড়ছে মধু। শিশুরা তালুতে মুখ লাগিয়েই দিচ্ছে দৌড়। খাওয়ার পর তারা আঙুলে আঙুল ঠুকে একে অপরকে কী বোঝাচ্ছে, তা আর বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বোঝা গেল, তারা ইশারা ভাষায় কথা বলছে। একজন শিক্ষক সেটা অনুবাদ করে দিলেন। যার অর্থ হচ্ছে, ‘মধু খুব ভালো। মজা পেলাম।’
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহী নগরের ষষ্ঠী তলা এলাকায় বাক্-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে এই ব্যতিক্রমী মধু খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে মৌয়াল-চাষি-বণিক-গবেষক-উদ্যোক্তা-ভোক্তা জাতীয় জোট।
আয়োজকেরা জানান, ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব মধুর মান নির্ধারণ করে বিএসটিআই গেজেট (দ্বিতীয় সংস্করণ) প্রকাশ করে। এই দিনকে মৌচাষিরা ‘মধু সেবন দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকেন। এ উপলক্ষে সংগঠনের পক্ষে রাজশাহীতে বাক্-শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আনুষ্ঠানিক মধু সেবনের আয়োজন করা হয়। তাদের এবারের স্লোগান ছিল—‘মানুষে মানুষে নাই ভেদাভেদ গড়ে তুলি সাম্য, প্রতিদিন মধু সেবনে হয়ে উঠি অদম্য।’
উদ্যোক্তা মঈনুল আনোয়ার এই মধু সেবনের জন্য এই প্রতীকী মৌচাক তৈরি করেছেন। দেখলে মনে হয়, স্ট্যান্ডের সঙ্গে একটা মৌচাক ঝুলে আছে। এর নিচে ‘সেন্সর’ লাগানো রয়েছে। হাত পাতলেই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মধু হাতের তালুতে গড়িয়ে পড়ে। তিনি এই মৌচাকের নাম দিয়েছেন—‘হাত বাড়ালেই মধু’।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেলা একটার দিকে মৌচাষিরা প্রতীকী মৌচাকটি নিয়ে এসে বিদ্যালয়ের বারান্দায় রাখেন। তখন কয়েকটি বাক্প্রতিবন্ধী শিশু জিনিসটা দেখতে আসে। পরীক্ষামূলকভাবে আয়োজকদের দু-একজন হাত পেতে মধু নিয়ে খায়। তখনই ওই শিশুরা বুঝতে পারে, তাদের আজ মধু খাওয়াানো হবে। সঙ্গে তারা হাত নেড়ে ইশারা ভাষায় অন্যদের কী একটা খবর দিয়ে দিল। আর হড়হড় করে বারান্দা দিয়ে একদল শিশু দৌড়ে এল। তারা চারদিকে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে সে কী উচ্ছ্বাস! শুধু বোঝা যাচ্ছিল না, তারা কী বলছে।
এবার আনুষ্ঠানিক মধু পান করানোর পালা। শিক্ষকেরা কী যেন একটা ইশারা করলেন। অমনি শিশুর দল সেখান থেকে দৌড়ে চলে গেল। ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় সবাই ফিরে এল। এবার সবার গায়ে বিদ্যালয়ের ইউনিফর্ম। সুন্দর পরিপাটি হয়ে তারা এসেছে। প্রথমে ছোট্ট একটি শিশু মধুর জন্য মৌচাকের নিচে হাত পাতল। সঙ্গে সঙ্গে তালু ভরে চাক থেকে মধু পড়ল। মধু হাতে নিয়ে শিশুটির যে কী উত্তেজনা,Ñভিড় ঠেলে সে ছুটে বেরিয়ে এল। তারপর আস্তে করে তালুতে মুখ লাগাল। তার খাওয়ার দৃশ্য দেখতে আরও কয়েকজন এমন করে তাকে ঘিরে ধরে তাকিয়ে থাকল যেন তারাও মধু সেবন করছে। তালু চেটে মধু খেয়ে ছেলেটি তার ইশারায় কী যেন একটা বোঝাল। সবাই যেন চনমনে হয়ে উঠল। একে একে অর্ধশাধিক শিশুর মধু সেবন শেষ হলো। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে একটি করে ব্যাগ তুলে দেওয়া হলো। প্রত্যেকের ব্যাগে ছিল মধুর উপহার হিসেবে এক বোতল করে মধু।
উপহার দেওয়ার শুরুতে পঞ্চম শ্রেণির দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী মারিয়া খাতুন ব্রেইল পদ্ধতিতে দিবসের প্রতিপাদ্যটি পাঠ করল। তারপর সবার হাতে আয়োজকেরা উপহারের ব্যাগ তুলে দিলেন। অনুষ্ঠানে রাজশাহী জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা নূরুল আমিন, মৌচাষি আকমল হোসেন মাহমুদ, শাহবুদ্দিন, শাহীন আলম, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আক্তারি খানমসহ অন্য শিক্ষকেরা উপস্থিত ছিলেন।
ফিরে আসার সময় খুব জানতে ইচ্ছা করল—মধু সেবন শেষে শিক্ষার্থীরা সবাই একযোগে বৃদ্ধাঙুল বের করে কী যেন একটা বুঝিয়ে দিল। প্রধান শিক্ষকের কাছে এর অর্থ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছে মানে বলেছে ‘ঠিক আছে’।