আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন বৃদ্ধ নারী আয়মন নেছা। বুধবার সকালে ময়মনসিংহের ফুলপুর সিংহেশ্বর উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে
আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন বৃদ্ধ নারী আয়মন নেছা। বুধবার সকালে ময়মনসিংহের ফুলপুর সিংহেশ্বর উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে

‘বাড়িঘর এককেরে ভাইসা গেছে গা’

আয়মন নেছার বয়স ৭৫ বছর। তাঁর বসতঘরটি পানিতে তলিয়ে গেছে। তিনি গতকাল মঙ্গলবার ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। সঙ্গে একমাত্র ছেলে ইটভাটাশ্রমিক মোশাররফ হোসেন, তাঁর স্ত্রী ও সন্তান আছে। আজ বুধবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে ময়মনসিংহের ফুলপুর সিংহেশ্বর উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে তাঁদের দুর্ভোগ পোহাতে দেখা যায়।

এই আশ্রয়কেন্দ্রে বন্যাকবলিত ৮৬ জন ঠাঁই নিয়েছেন। কারও বাড়ি বন্যায় ভেঙে গেছে, কারও বাড়ি তলিয়ে আছে পানিতে। সেখানে আলাপকালে বৃদ্ধ নারী আয়মন নেছা বলেন, ‘বাড়িঘর এককেরে ভাইসা গেছে গা। এক মাস পরে গেলেও বাড়িত দাঁড়ানির জায়গা হবো না। ছেলের বাড়িও শ্যাষ, আমার ডাও শেষ। একটা জিনিসও বাড়ি থিকা আনতে পারি নাই। ঢলে সব নিয়ে গ্যাছে গা। এই রহম পানি যে অইবো, হনহেও (স্বপ্নেও) ভাবছি না।’

আশ্রয়কেন্দ্রের কক্ষগুলোতে মিলেমিশে বসবাস করছেন দুর্গত লোকজন। সেখানে শিশুদের ছোটাছুটি করতে দেখা গেল। দনারভিটা গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী আবুল হোসেন পাঁচ সন্তান নিয়ে তিন দিন এ আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। আজ সকালে তাঁদের জন্য এলাকাবাসী মুড়ি, বাচ্চাদের রুটি ও বিস্কুট দিয়ে গেছেন। দুপুরে হয়তো কেউ খিচুড়ি বা অন্য কোনো খাবার নিয়ে আসবেন সেই আশায় বেঞ্চে বসে ছিলেন আবুল হোসেন।
সিংহেশ্বর উচ্চবিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল হক বলেন, ৬ অক্টোবর থেকে তাঁদের বিদ্যালয়টি বন্যাকবলিত মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে চালু করা হয়। এখানে ২৬টি পরিবারের ৮৬ জন্য সদস্য আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের খাবার দিচ্ছেন স্থানীয় বিভিন্ন লোকজন।

বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে সড়ক। আজ বুধবার সকালে ময়মনসিংহের ফুলপুর সিংহেশ্বর ইউনিয়নের ভাটপাড়া সড়কে

ইটভাটাশ্রমিকের কাজ করেন দনারভিটা গ্রামের আলাল উদ্দিন। দুই মেয়ে ও এক প্রতিবন্ধী ছেলেকে নিয়ে তিনি আশ্রয়কেন্দ্র এসেছেন। বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে তাঁর ঘরবাড়ি। গোয়ালের গরুটিও বের করে আনতে পারেননি। আলাল উদ্দিন বলেন, ‘এইভাবে যে পানি আইসা আমগোর ঘরবাড়ি লইয়া যাইব গা, তা কোনো সময় কল্পনাও করি নাই। অহন আর ঘর তুইল্যা থাহনের কোনো জায়গা নাই। ঘরের মাল ছামানা, গতরের কাপড়ও বাইর করতে পারি নাই।’ তিনি আরও বলেন, এলাকার মানুষ ও রাজনৈতিক নেতারা খাবার নিয়ে আসেন। কিন্তু সরকারি লোকজন খবর নিতে আসেননি।

৫২ বছর বয়সী ইটাভাটাশ্রমিক আবদুল মোতালেবের বাড়ি দনারভিটা গ্রামে। গত রোববার বিকেলে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও মেয়ে তাঁর সঙ্গে আছেন। তাঁর বৃদ্ধ মা আমেনা খাতুন ও দুই ভাই পানিবন্দী হয়ে বাড়িতে আছেন। পানির তোড়ে তাঁদের ঘর ভেঙে দেবে গেছে। ফুলপুরের ইছামতী নদীর পাড়ে তাঁদের বাড়ি। গত শনিবার পানি আসতে শুরু করলেও রোববার ভয়াবহ রূপ নেয়। পরে বাড়ি ছেড়ে মোতালেব আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন। মোতালেব বললেন, ‘আমর মা বাড়িত পানির ওপরে বাস করতাছে। বাড়ি ছাইড়া আইতো চাইতাছে না, অনেক বুঝায়া কইলাম, কিন্তু আইলো না।’

ফুলপুর সিংহেশ্বর উচ্চবিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন বন্যাকবলিত লোকজন। আজ বুধবার সকালে

আশ্রয়কেন্দ্রের বারান্দার গ্রিল ধরে তিন বছর বয়সী নাতনি কাকলী আক্তারকে নিয়ে বিমর্ষ মনে বসে ছিলেন রোকেয়া বেগম (৪৫)। তাঁর স্বামী আবু বক্কর ইটভাটাশ্রমিক। রোকেয়া জানালেন, সাত কাঠা জমির ধান, চার শতক জমির বাড়ি সব পানিতে ভেসে গেছে। সামনের দিনগুলো অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমরারে পথে বসিয়ে দিল বন্যা। জীবনেও দেহি নাই এন বন্যা। সরকারি সহযোগিতা ছাড়া আর খাড়নির বাউ নাই।’

আজ সকালে আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য আসেন ফুলপুর উপজেলা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক শামীম আরা। তিনি বলেন, বিশুদ্ধ পানির জন্য বন্যার পর মানুষ চর্মরোগ ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। সে কারণে পানিতে বন্যার পানিতে নামা থেকে বিরত থাকতে হবে। আর খেতে হবে বিশুদ্ধ পানি।