‘শহীদ মিনারের নির্মলতা রক্ষার স্বার্থে বিদ্যমান গাছ কাটা যাবে না। শহরবাসীর জন্য একটু উন্মুক্ত স্থান চাই। পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদ।’ একটি আমগাছে এই সাইনবোর্ড ঝোলানো। নিচেই ডালপালা নিয়ে লুটিয়ে পড়েছে বয়সী একটি কদমগাছ। খানিকটা দূরে কাটা পড়েছে দুটি সেগুনগাছ। একটি কড়ই ও জামগাছের গোড়ায় কোপ পড়েছে। এভাবেই রাজশাহীতে গাছ কেটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে গাছ কাটা শুরুও হয়েছিল। দুপুরে খবর পেয়ে পরিবেশবাদীরা গিয়ে গাছ কাটা বন্ধ করে দেন। দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা পাঁচটি গাছের মধ্যে এক দিনেই তিনটি কেটে ফেলা হয়েছে। অন্য দুটির মধ্যে একটি কড়ইগাছের ডালপালা ছেঁটে ফেলার পর শিকড় কাটা শুরু হয়েছিল। গাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। পাকা জাম ধরে থাকা আরেকটি গাছ কাটতে গোড়া থেকে মাটি সরানো হচ্ছিল। পরিবেশবাদীদের বাধায় গাছ দুটি প্রাণে বেঁচেছে। গত সোমবার প্রথম আলোতে ‘গাছ বাঁচিয়েই শহীদ মিনারের নকশা হোক’ শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়।
যে তিনটি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে তার মধ্যে একটি কদম ও দুটি সেগুন।সেগুনগাছের নিচের দিকের কোটরে পাখির বাসা ছিল। কোটরের ভেতরে শুধু পাখির বাসার খড়কুটো দেখা গেছে। কেটে ফেলা তিনটি গাছ থেকে কয়েকটি পাখির বাসা পড়ে ছিল এখানে-ওখানে। তা দেখে হতাশা প্রকাশ করছিলেন পরিবেশবাদীরা।
নগরের সোনাদিঘি এলাকায় নিজস্ব জায়গায় প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা খরচ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা পরিষদ। স্থানটিতে আগে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সার্ভে ইনস্টিটিউট ছিল। অনেক আগে থেকেই সেখানে ২০-২২টি গাছ আছে। এর মধ্যে কয়েকটি শতবর্ষী। পরিবেশবাদীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণকে স্বাগত জানালেও গাছ হত্যার বিপক্ষে।
গাছ কেটে শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে বেশ কয়েক দিন ধরেই প্রতিবাদ করে আসছিল রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদ। গত ২২ মে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা শহীদ মিনার নির্মাণের নির্ধারিত স্থানে সমাবেশ করেন। এরপর ২৫ মে তাঁরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর ইকবালের সঙ্গেও দেখা করেন। গাছ না কাটার দাবিতে স্মারকলিপি দেন। সংগঠনের সদস্যদের দাবি, সেদিন চেয়ারম্যান গাছ রেখেই নকশা বদলে শহীদ মিনার নির্মাণের কথা বলেছিলেন।
৬ জুন জেলা পরিষদ পাঁচটি বড় বড় গাছ বিক্রির দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্রে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায় গাছগুলো ‘মেসার্স মেঘনা এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান কিনে নেয়। ১১ জুন প্রতিষ্ঠানটিকে গাছ কাটার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এতে সাত দিনের মধ্যে গাছ কেটে নিতে বলা হয়। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে গাছের ক্রেতা নগরের সাগরপাড়া এলাকার বাসিন্দা মো. সুমন শ্রমিকদের নিয়ে গাছ কাটা শুরু করেন। দুপুরে খবর পান পরিবেশবাদীরা।
দুপুরে একটি হ্যান্ডমাইক নিয়ে সেখানে ছুটে যান সংগঠনের পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদ এক সদস্য। অন্য সদস্যরাও একে একে জড়ো হতে থাকেন। এর মধ্যে সংগঠনটির সদস্যসচিব নাজমুল হোসেন ছুটে এসে গাছ কাটতে বারণ করেন। তিনি বলেন, গাছে কোপ দেওয়ার আগে তাঁর হাতে কোপ দিতে হবে। তাঁর ওই কথা শোনার পর শ্রমিকেরা গাছ কাটা বন্ধ করে দেন।
নাজমুল হোসেন বলেন, ‘এই গাছগুলোর কোনো কোনোটির বয়স ১০০ বছরের বেশি। অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে গাছগুলো ঘিরে। এগুলো কাটা হবে না বলে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কথা রাখলেন না। এটা দুঃখজনক। আমরা আর একটি গাছও কাটতে দেব না। কেউ গাছ কাটতে এলে আমরা রুখে দাঁড়াব।’
খবর পেয়ে এসেছিলেন পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংস্থা বারসিকের গবেষক শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অনেক সময় বলা হয়, বড় গাছ কেটে ছোট গাছ বেশি করে লাগিয়ে দেওয়া হবে। এতে সমস্যার সমাধান হয় না। একটা বড় গাছ যেভাবে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করতে পারে, ছোট গাছ পারে না। তাই আমরা এখনো দাবি করছি, যে কয়েকটি বড় গাছ আগের, সেগুলো যেন আর কাটা না হয়।’
জেলা পরিষদ পাঁচটি গাছ বিক্রি করেছে মাত্র ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায়। পরিবেশবাদীরা অভিযোগ তুলেছেন, গাছের মূল্য নির্ধারণেও আছে শুভংকরের ফাঁকি। পাঁচটি গাছের মধ্যে শতবর্ষী একটি কড়ইগাছের দামই দুই লাখ টাকা হবে। এত কম টাকায় গাছ বিক্রির এমন তোড়জোড় তদন্ত করে দেখার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
গাছগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় কার্যালয়। জানতে চাইলে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুজ্জামান শাহ বলেন, ‘আমাদের প্রতিনিধি সরেজমিনে গাছ দেখে মূল্য নির্ধারণ করেছে।’ প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা না রাখার বিষয়ে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।