মেঘনা ও এর শাখা নদ-নদীর অভয়াশ্রমে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও মা-ইলিশ শিকার বন্ধ করা যাচ্ছে না। ছোট-বড় ইঞ্জিনচালিত অসংখ্য নৌকা নিয়ে এসব এলাকায় দিন-রাত মা ইলিশ শিকার করা হচ্ছে। এর পেছনের এখন বিএনপির নেতারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জেলেরা জানিয়েছেন।
মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত হামলার শিকার হচ্ছেন। অভিযান শুরুর প্রথম পাঁচ দিনে তিন দফায় হামলার শিকার হয়েছেন তাঁরা। সর্বশেষ গত শুক্রবার বিকেলে হিজলা-গৌরব্দী ইউনিয়নের ওরাকল বাজারের ৭ নম্বর ঘাটসংলগ্ন মেঘনা নদীতে অভিযান চালাতে গেলে হামলা শিকার হয়েছেন হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), একজন আনসার সদস্য ও মৎস্য বিভাগের তিন কর্মচারী।
হিজলার ইউএনও মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এখানে দুই ধরনের জেলে দুই এলাকায় মাছ ধরেন। মূল মেঘনায় বড় বড় ট্রলার নিয়ে সংঘবদ্ধ জেলেরা ইলিশ নিধন করেন। তাঁরা আসলেই কাউকেই ভয় পান না।
অভিযোগ রয়েছে—হিজলা উপজেলা বিএনপির কয়েকজন নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় হিজলা, ভোলা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও চাঁদপুরের জেলেদের নিয়ে অবৈধ চক্র গড়ে উঠেছে। চক্রটি শিকার করা ইলিশ সন্ধ্যা ও ভোরে মেঘনা নদীর তীরে কয়েকটি এলাকায় নিলামে বিক্রির পর শরীয়তপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর ও মাওয়া থেকে আসা পাইকাররা কিনে স্পিডবোট ও ট্রলারে করে নিয়ে চলে যান।
মৎস্য বিভাগ থেকে জানা যায়, বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর নদের হবিনগর পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জের বামনীরচর পয়েন্ট পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার, মেহেন্দীগঞ্জের গজারিয়া নদীর হাট পয়েন্ট থেকে হিজলা লঞ্চঘাট পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার, হিজলার মেঘনার মৌলভীর হাট পয়েন্ট থেকে মেহেন্দীগঞ্জ-সংলগ্ন মেঘনার দক্ষিণ-পশ্চিম জাঙ্গালিয়া পয়েন্ট পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার এলাকা ইলিশের অভয়াশ্রম। ২০১৯ সালে সরকার দেশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে এলাকাটি গেজেটভুক্ত করে। এই সীমানার মধ্যে কালাবদর, আড়িয়াল খাঁ, নয়ভাঙ্গুলী, গজারিয়া ও কীর্তনখোলা নদ-নদী আছে।
হটস্পট জানপুর
জেলে ও মাছ ব্যবসায় সংশ্লিষ্টরা জানান, শরীয়তপুরের গোসাইরহাট, চাঁদপুরের হাইমচর এবং বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ সীমানার মেঘনার জানপুর এলাকাটি অবৈধ ইলিশ শিকারের মূলকেন্দ্র (হটস্পট) হয়ে উঠেছে। মূলত হিজলার জানপুর ঘিরেই এসব মাছ কেনাবেচা ও পাচার হয়। এলাকাটি দুর্গম এবং কয়েকটি জেলার মোহনা হওয়ায় এককভাবে কোনো জেলার প্রশাসন অভিযান চালাতে গেলে সীমানা জটিলতায় পড়ে। এই সুযোগ নিয়েই এসব এলাকায় অন্তত দুই হাজার জেলে বড় বড় ট্রলার নিয়ে দিন-রাত ইলিশ ধরছেন। এসব ট্রলারের প্রতিটিতে ২০ থেকে ৩০ জন জেলে থাকেন। অভিযানকারী দল যাতে তাঁদের ধরতে না পারেন, সে জন্য এসব ট্রলারে দুই থেকে তিনটি ইঞ্জিন লাগানো হয়েছে। এসব ট্রলার ‘ফাইটার’ নামে পরিচিত। তবে জেলেরা সংঘবদ্ধ হওয়ায় সহসা অভিযানকারী দল দেখে তাঁর পালান না। সংঘবদ্ধ হয়ে উল্টো তাঁরা ইট ও পাথর ছুড়ে মারেন। সেই সঙ্গে প্রবল ঢেউ তৈরি করে বাঁশ, গজারির লাঠি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলাও চালান। লাঠির মাথায় কাপড় পেঁচিয়ে পেট্রল দিয়ে আগুনের গোল্লা বানিয়ে অভিযান পরিচালনাকারীদের দিকে ছুড়ে মারেন।
হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, হিজলা উপজেলার আয়তন ৫১৫ দশমিক ৩৬ বর্গকিলোমিটার। মেহেন্দীগঞ্জের আয়তন ৪১৮ দশমিক ৯৭ বর্গকিলোমিটার। দুটি উপজেলার ৮০ ভাগ মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। এসব এলাকা মেঘনা অববাহিকা ও অন্যান্য শাখা নদীর দুর্গম চরবেষ্টিত। ফলে মূল ভূখণ্ড থেকে এসব এলাকায় স্পিডবোটে গেলেও ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগে। দুটি উপজেলা চাঁদপুর, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, ভোলা ও শরীয়তপুর এই পাঁচ জেলার মধ্যবর্তী দ্বীপে অবস্থিত। হিজলার জানপুর হচ্ছে এমন একটি দুর্গম এলাকা, যেখানে এই পাঁচ জেলার মোহনা। এলাকাটি হিজলা-গৌরব্দী ইউনিয়নে পড়েছে।
আমি এসব ঘটনার ধারেকাছেও নেই। পুলিশ-প্রশাসন থেকে আমাকে ফোন করে এসব জানাতে চেয়েছে। আমি তাদের বলেছি, আপনারা এলাকায় এসে সত্যতা যাচাই করুন।সুজন সরদার, সহসভাপতি, বরিশাল জেলা ছাত্রদল
স্থানীয় জেলেদের দাবি, পুরো এলাকায় ইলিশ নিধন কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে হিজলা থেকে। জানপুরে অন্তত ২০টি মাছঘাট আছে। ৩ নম্বর ঘাট হচ্ছে সবচেয়ে বড় মাছঘাট। এই এলাকার মাছঘাট নিয়ন্ত্রণ করেন হিজলা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল গাফফার তালুকদার। তাঁর সঙ্গে উপজেলা বিএনপির আরও প্রভাবশালী দুই নেতা আছেন। আগে নিয়ন্ত্রণে ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও হিজলা-গৌরব্দী ইউপির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ওরফে মিলন। সঙ্গে ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক ও বড়জালিয়া ইউপির চেয়ারম্যান এনায়েত হোসেন হাওলাদার।
জানপুর এলাকায় আবদুল গাফফার তালুকদার তাঁর ১০টি মাছের ঘাট ও আড়তে লুটপাটের অভিযোগে ৮ অক্টোবর হিজলা থানায় মামলা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম মামলার প্রধান আসামি। মামলা হওয়ার দিনই নজরুল গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
জানপুরের অন্তত দুজন মাছ ব্যবসায়ী জানান, জানপুর ৩ নম্বর ঘাট থেকে ১৫ থেকে ২০টি স্পিডবোটে প্রতিদিন ন্যূনতম ৫০ লাখ টাকার মাছ ভৈরব, নোয়াখালী, মাওয়া, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও হাইমচরে যায়। এ জন্য মাওয়া থেকে ২২ দিনের জন্য এসব স্পিডবোট ভাড়ায় আনা হয়েছে। জানপুর ছাড়াও মেঘনা ও শাখা নদীতে আশলী আবুপুর, আবুপুর ও হরিনাথপুর এলাকায় ইঞ্জিনচালিত কয়েক শ ছোট নৌকা দিয়ে ইলিশ শিকার করা হচ্ছে।
প্রতিদিন জেলেদের ছোট নৌকায় ৩০-৩৫ হাজার এবং বড় নৌকায় দেড় থেকে ২ লাখ টাকার ইলিশ ধরা পড়ে। যদি দুই-চারজন জেলে ধরাও পড়েন। তবে ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিলেও বিশাল অঙ্কের লাভ পকেটেই থেকে যায়। আর নতুন এই কৌশলে তাঁরা বেশ সফলতাও পেয়েছেন।
ধরা পড়লে জরিমানা দিয়ে মুক্তি
মৎস্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকায় ইলিশ সাম্রাজ্যের দখলকারী বিএনপি নেতারা নিজেদের ক্ষমতার প্রভাবকে পুরো মাত্রায় প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটাতে পারছেন না। তাই তাঁরা তাঁদের নিয়ন্ত্রিত কয়েক হাজার জেলেকে মাছ ধরতে নামাচ্ছেন এবং অভিযানে ধরা পড়লে কারাগারে দেওয়ার পরিবর্তে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার মাধ্যমে ছাড়িয়ে আনছেন। বিএনপি নেতাদের হিসাব হলো—প্রতিদিন জেলেদের ছোট নৌকায় ৩০-৩৫ হাজার এবং বড় নৌকায় দেড় থেকে ২ লাখ টাকার ইলিশ ধরা পড়ে। যদি দুই-চারজন জেলে ধরাও পড়েন। তবে ১২ থেকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিলেও বিশাল অঙ্কের লাভ পকেটেই থেকে যায়। আর নতুন এই কৌশলে তাঁরা বেশ সফলতাও পেয়েছেন।
আবুপুর, হরিনাথপুর, আশুলি আবুপুর এলাকার কয়েকজন জেলে জানান, প্রশাসন ম্যানেজ করার জন্য তাঁরা বিএনপি নেতা খালেক মাঝি, সুজন সরদার, সোহেল ব্যাপারীকে টাকা দেন। বিএনপি নেতারা ছোট নৌকা থেকে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা নেন।
সুজন সরদার বরিশাল জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এসব ঘটনার ধারেকাছেও নেই। পুলিশ-প্রশাসন থেকে আমাকে ফোন করে এসব জানাতে চেয়েছে। আমি তাদের বলেছি, আপনারা এলাকায় এসে সত্যতা যাচাই করুন। আমি অস্বীকার কবর না যে, এখানে আমাদের দলীয় লোকজন জড়িত নেই। তারা অনেকে আমার নাম বিক্রি করছে। এতে আমি বিব্রত।’
একটি বড় চক্র অবৈধভাবে ইলিশ শিকার করছে। চক্রটির অপতৎপরতা বন্ধে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশের সহায়তায় চাঁদপুর জেলা প্রশাসন কাজ করছে।নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, উপপরিচালক, বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তর
এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী হাট বসিয়ে সেখানে আনা ইলিশ নিলাম ডাকে বিক্রি হচ্ছে। গত রোববার সকালে হিজলার বাউশিয়া লঞ্চঘাট, পুরাতন হিজলা নদীর পাড়ের মন্দির এলাকায়, কাইসমা খলিলের ইটের ভাটার পাশের খালপারে, হরিনাথপুর ও আবুপুর ইলিশ বিক্রি হতে দেখা গেছে। ছোট নৌকার জেলেরা এসব এলাকায় ইলিশ বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন। এসব স্থানে বিএনপি নেতাদের মনোনীত লোকজন ডাকে মাছ বিক্রি করছেন।
ইলিশ বিক্রি করতে আসা তিনজন জেলে জানালেন, এগুলো স্থায়ী কোনো মাছঘাট নয়। ছোট জেলেরা মেঘনার শাখা নদী থেকে ২২ দিনে যে ইলিশ ধরে আনবেন, তা অস্থায়ীভাবে বসানো এসব ঘাটে বাধ্যতামূলক বিক্রি করতে হয়। এসব ঘাট যাঁরা বসিয়েছেন, তাঁরা সবাই বিএনপির কোনো না কোনো ইউনিয়ন অথবা ওয়ার্ড কমিটির নেতা। এসব ঘাটে মাছ বিক্রির টাকা থেকে শতকরা ২০ ভাগ কমিশন নেন তাঁরা।
কেন থামানো যাচ্ছে না
স্থানীয় প্রশাসন, জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেঘনায় নিষেধাজ্ঞার সময়েও মা ইলিশ ও জাটকা ধরা বন্ধ করতে না পারার পেছনে মূল কারণ রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা। অনেক জেলে সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন, কখন ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শুরু হবে। নিষেধাজ্ঞার ২২ দিনে যা আয় করেন, তা দিয়ে সারা বছর চলেন। শুধু পেশাদার জেলে নন, অন্য এলাকা থেকেও জেলেদের আনা হয়। অন্য পেশায় থাকা লোকজনকেও মৌসুমি জেলে হিসেবে আনা হয়।
বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তাঁদের আমি হুঁশিয়ার করে দিয়েছি। এরপরও যদি তাঁরা নির্বৃত্ত না হন, তাহলে আমি বলব, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক।’
বিএনপি নেতা আবদুল গাফফার তালুকদার বলেন, ‘আমার হিজলা এলাকায় কেউ অবৈধভাবে মাছ ধরে না। শরীয়তপুর, হাইমচর, হরিনাথপুর, আবুপুর, মেহেন্দীগঞ্জের কয়েক হাজার জেলে মাছ ধরে। এতে আমার কি করার আছে? আমরা এর মধ্যে নাই।’
মেঘনার শাখা নদীগুলোয় কয়েক শ ছোট নৌকায় মাছ ধরা হয়। মাছ ধরার কাজ করেন শ তিনেক বেদে নারী। যাঁদের প্রতিটি নৌকায় নবজাতক থেকে তিন থেকে চারজন বিভিন্ন বয়সের শিশু আছে। আরও আছে অগণিত কিশোর জেলে। অভিযান চালাতে গেলে সবচেয়ে বড় বাধা এসব শিশু-কিশোর।
জানতে চাইলে বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, একটি বড় চক্র অবৈধভাবে ইলিশ শিকার করছে। চক্রটির অপতৎপরতা বন্ধে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশের সহায়তায় চাঁদপুর জেলা প্রশাসন কাজ করছে। তবে এসব জেলেরা এখনো সক্রিয় আছেন। অভিযান চালাতে গিয়ে গত কয়েক বছরের মতো এবারও জেলেদের হামলার ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি উদ্বেগের, তারপরও অভিযান অব্যাহত আছে। চক্রের কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে।