মুক্তিযুদ্ধকালে কাদেরিয়া বাহিনীর বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র জমা দেওয়ার ঘটনার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে গতকাল মঙ্গলবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস যোগ দেন। এ নিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।
অনুষ্ঠানে এসে মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর বিশেষ অবদানের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করলেন মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতা। ভবিষ্যতে তাঁকে নিয়ে জোট করার ইঙ্গিত ছিল তাঁদের বক্তব্যে। এদিকে তাঁদের উপস্থিতিতে কাদের সিদ্দিকী তাঁর বক্তৃতায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং জেলার সংসদ সদস্যদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। এ নিয়েই এ অস্বস্তি ও ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও কয়েকজন সংসদ সদস্য। এ ছাড়া আবদুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের আমন্ত্রণে একজন মন্ত্রী ও একজন কেন্দ্রীয় নেতা জেলায় এলেও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁদের এ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার বিষয়ে কিছুই জানতেন না।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে যান। তিনি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। আওয়ামী লীগ থেকে বের হওয়ার আগে থেকেই জেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর দূরত্ব ছিল। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতাই আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ফলে দলটি সাংগঠনিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে।
গত ২৩ ডিসেম্বর কাদের সিদ্দিকী সপরিবার গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর পর থেকেই রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন শুরু হয়, তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে যাচ্ছেন। ওই সাক্ষাতের পর গতকালই ছিল কাদের সিদ্দিকীর টাঙ্গাইলে প্রথম কোনো সভা।
টাঙ্গাইল শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতার উপস্থিতিতে ওই অনুষ্ঠানে বক্তৃতার একপর্যায়ে কাদের সিদ্দিকী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। কাদের সিদ্দিকী বলেন, অনুষ্ঠানে ফজলুর রহমান খানকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি অনুষ্ঠানে আসতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। এ জন্য তাঁকে (ফজলুর রহমান) আর শ্রদ্ধা করেন না। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ফজলুর রহমান খানকে একুশে পদক দেওয়া সঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেন। এ ছাড়া জেলার সংসদ সদস্যদের অযোগ্য বলে উল্লেখ করেন।
এ প্রসঙ্গে ফজলুর রহমান খানের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের সংসদ সদস্য হাসান ইমাম খান ওরফে সোহেল হাজারী বলেন, আওয়ামী লীগের সতীর্থ হলে কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও দলের নেতাদের সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতে পারতেন না। দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদ সদস্যদের মনোননয়ন দিয়েছেন। তাঁদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা মানে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বক্তৃতাকালে বলেন, ‘বঙ্গবীরের বক্তব্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সম্পর্কে যে মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, তা আমার জন্য বিব্রতকর। আমরা এই অনুষ্ঠানকে জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেখতে চাই। সম্পর্কের কোনো অবনতি থাকলে তা জাতীয়ভাবে নিতে চাই না।’
জেলার নেতাদের না জানিয়ে কাদের সিদ্দিকীর অনুষ্ঠানে মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতার যোগদান, কাদের সিদ্দিকীর প্রশংসা, অপর দিকে কাদের সিদ্দিকীর বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা।
আজ বুধবার এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের অন্তত ১০ জন নেতা এবং ৪ জন সংসদ সদস্যের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, মৃণাল কান্তি দাস বক্তব্যে বলেছেন, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে তিনি টাঙ্গাইলের এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। অথচ কেন্দ্র থেকে জেলার নেতাদের এ সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি। এটা তাঁদের জন্য অস্বস্তিকর।
জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য বিদায়ী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র জামিলুর রহমান বলেন, ‘বহুদিন পর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর গত ডিসেম্বরে সাক্ষাৎ হয়েছে। আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু মন্ত্রীর উপস্থিতিতে দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতাদের সম্পর্কে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে আমরা হতাশ হয়েছি।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য জোয়াহেরুল ইসলাম বলেন, ‘কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে জোট হওয়ার বিষয়ে কেন্দ্র থেকে কোনো নির্দেশনা পাননি। বঙ্গবন্ধুর কাছে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র জমাদানের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে একজন মন্ত্রী ও একজন কেন্দ্রীয় নেতা কীভাবে এলেন, সে সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। আমরা দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশনার বাইরে নেই। তবে জেলায় দলের শৃঙ্খলা যাতে বজায় থাকে, সে বিষয়ও কেন্দ্রীয় নেতারা লক্ষ রাখবেন, সেই প্রত্যাশা করি।’