প্রত্যাবাসন কমিশনারের সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশ চায় না, আর একজন রোহিঙ্গাও এ দেশে আসুক

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে দুই মাস ধরে চলছে গোলাগুলি ও মর্টারের গোলা নিক্ষেপের ঘটনা। এ নিয়ে আতঙ্কে এপারের নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফের মানুষ। নাফ নদী পেরিয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কাও জাগছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়শিবিরগুলোতে অপরাধ বাড়ছে। আশ্রয়শিবিরের সবকিছু দেখভাল করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়। সব বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা ও সরকারের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সঙ্গে।

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
মোহাম্মদ মিজানুর রহমান
প্রশ্ন

প্রথম আলো: উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে ৫ বছর ধরে আছে সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গা। সেখানে হত্যা, অপহরণ, মাদক চোরাচালান বেড়েই চলেছে। পরিস্থিতি এমন হচ্ছে কেন?

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান: এ রকম হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, ওরা (রোহিঙ্গারা) যে পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে এসেছে, স্বাভাবিকভাবে ওরা নির্যাতনের শিকার ছিল। তাদের মানবিক গুণাবলির সংকট আছে। অন্যদিকে তাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাব আছে।

প্রত্যেকে নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায় আছে। অথচ যোগ্যতাসম্পন্ন নেতা নেই। এর ফলে ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি হয়েছে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, খুনখারাবিতে জড়াচ্ছে। স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারে কিছু খুন হচ্ছে, নারীসংক্রান্ত বিষয়ে কিছু খুনের ঘটনা ঘটছে। সার্বিকভাবে এটা ওদের জন্য কল্যাণকর নয়, আমাদের জন্যও নয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ক্যাম্পে আর্মিড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), জেলা পুলিশ, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে। তবে এটা ঠিক যে সীমান্ত পরিস্থিতির কারণে এখানেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: মিয়ানমার সীমান্তে দুই মাস ধরে চলছে গোলাগুলি-সংঘর্ষ। আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। আপনার ধারণা কী?

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান: আমরা কোনোভাবেই চাই না, আর একজনও আমাদের সীমানায় প্রবেশ করুক। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি তৎপর আছে। যেহেতু পাঁচ বছরে মিয়ানমার কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি, সীমান্ত পরিস্থিতি খারাপ হলে আরও রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসার শঙ্কা আছে। আমরা এমনিতেই ১২ লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। চাপ কমানোর জন্য কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে (নোয়াখালীতে) স্থানান্তর করা হচ্ছে, সরকার অনেক টাকা খরচ করেছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হলে ক্যাম্পে থাকা ছয় লাখ রোহিঙ্গা তরুণ-যুবক মাদক চোরাচালান ও সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়তে পারেন। তখন দেশের জননিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে না?

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান: আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা শিশু, কিশোর ও তরুণেরা যেন সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মাদক চোরাচালানে না জড়ান, সে জন্য ক্যাম্পের ভেতরে কাজ চলছে। আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে ক্যাম্পের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করা। পাশাপাশি মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে রাখা।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: আশ্রয়শিবিরের ভেতরে নিরাপত্তাঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় এনজিও-আইএনজিওর সেবা কার্যক্রম সীমিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান: আমার মনে হয়, কথাটা সত্য নয়। রোহিঙ্গা সংকটের পাঁচ বছর হয়ে গেছে। বিশ্বে এই মুহূর্তে রাশিয়া–ইউক্রেন সংকট প্রকট হয়েছে। আর্থিক মন্দাবস্থা বিশ্বজুড়ে। এসব কারণে দাতা সংস্থা, দাতা দেশ ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার বরাদ্দ আসছে কম। যে পরিমাণ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে, তা আগের বরাদ্দের মাত্র ৪৮ শতাংশ। এটি খুবই অ্যালার্মিং। এ কারণে অনেক সংস্থার কাজকর্ম সীমিত হয়ে পড়েছে। আশ্রয়শিবিরে কাজ করছে ৭০-৮০টির মতো এনজিও। কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তাঝুঁকি তেমন নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে পাঁচ বছর ধরে আছে চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। সীমান্তে গোলাগুলির ঘটনায় তারা শঙ্কিত। নিরাপত্তা চেয়ে শূন্যরেখার রোহিঙ্গারা জাতিসংঘে আবেদন করেছে। তাদের নিরাপত্তা অথবা স্থানান্তরের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত কী?

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান: এটা আমাদের বিষয় নয়। ওরা নো ম্যানস ল্যান্ডে আছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের সহায়তা দিচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা (রোহিঙ্গারা) আমাদের সীমানায় আসছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দায়দায়িত্ব নেই। সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। নাগরিকদের যদি সীমান্ত থেকে সরানো হয়, তখন শূন্যরেখার রোহিঙ্গাদের কী হবে, তার সিদ্ধান্ত নেবে সরকারের উচ্চমহল। এ ক্ষেত্রে আমার করার কিছু নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: রোহিঙ্গা শিবির এখন ডেঙ্গুর হটস্পট। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আপনারা কী করছেন?

মোহাম্মদ মিজানুর রহমান: ক্যাম্পের লোকগুলো যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তখন অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। ওরা ডিপথেরিয়া নিয়ে এসেছিল, যা কর্মসূচির মাধ্যমে নির্মূল করা হয়েছে। আশ্রয়শিবিরে দেশি–বিদেশি সহায়তায় রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনাতেও আগ্রহী হচ্ছে রোহিঙ্গারা।

আশ্রয়শিবিরে ডেঙ্গু বাড়ছে, এটা ঠিক। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা সব বিভাগ একসঙ্গে কাজ করছি। রোহিঙ্গাদের সচেতন করছি। এডিস মশা নিধনেও কার্যক্রম চলছে। শিবিরের প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো সরানো হচ্ছে।