শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয় রোগীদের

এই হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ ৫২টি। কিন্তু  কর্মরত আছেন ৩৫ জন। এখানে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পদ শূন্য।

শয্যাসংকটের কারণে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের ওয়ার্ডের বারান্দায় বিছানা পেতে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। সম্প্রতি তোলা ছবি

শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার চর জালালপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ নুরু গাজী (৬৫)। হাঁটু ও কোমরের ব্যথায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন। চিকিৎসা নিতে সোমবার সকাল নয়টায় শরীয়তপুর সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে যান। কিন্তু বেলা একটা পর্যন্ত তিনি চিকিৎসকের কক্ষে ঢুকতে পারেননি।

সদর উপজেলার দরিহালা গ্রামের ময়না আক্তার সোমবার এই হাসপাতালে গাইনি বিশেষজ্ঞকে দেখাতে এসেছেন। তিনি সকাল ১০টা থেকে চিকিৎসকের কক্ষের সামনে অপেক্ষা করছিলেন। অনেক ভিড় থাকায় চিকিৎসকের কক্ষে যেতে পারেননি। পরে চিকিৎসক না দেখিয়েই বেলা দেড়টার দিকে ফিরে গেছেন।

ময়না আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসক কম, রোগী বেশি। চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ডাক্তার দেখাতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ফিরে যেতে হলো। হাসপাতালে এসে যদি চিকিৎসা না পাই, তাহলে আমাদের মতো গরিব মানুষ যাবে কোথায়?’

চিকিৎসক–সংকটের কারণে নুরু গাজী ও ময়না আক্তারের মতো সোমবার সকাল থেকে কয়েক শ রোগী সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। অনেকে চার-পাঁচ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। আবার অনেকে চার–পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করে চিকিৎসক না পেয়ে ফিরে গেছেন।

নুরু গাজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোমর ও হাঁটুর ব্যথায় দাঁড়াতে পারি না। তাই সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বসে আছি। বেলা একটায়ও ডাক্তারের রুমে ঢুকতে পারি নাই। আমরা গরিব মানুষ। গ্রাম থিক্কা সরকারি হাসপাতালে আসি, সেখানে ঠিকমতো চিকিৎসা পাই না। এতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।’

সদর হাসপাতালটি ২০০৩ সালে ৫০ শয্যা হতে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে সদর হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যায় করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালের জনবল বাড়ানো হয়নি। ১০০ শয্যার জনবল দিয়েই চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম। বর্তমানে চিকিৎসক, নার্স, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর সংকট রয়েছে। এ কারণে এখানে এসে রোগীরা যথাযথ সেবা পাচ্ছেন না। শয্যা ও কক্ষের সংকট থাকায় মেঝে ও বারান্দায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা।

শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২০০৩ সালে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার পর শয্যাসংখ্যা বাড়ানো হয়েছিল। এরপর ২০১৪ সালে হাসপাতালে ১০০ শয্যার জনবলকাঠামো অনুমোদন দেওয়া হয়। ১০০ শয্যার হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ ৫২টি। কিন্তু এখানে কর্মরত আছেন ৩৫ জন। শূন্য ১৭টি পদের অধিকাংশই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। নার্সের ৭৬টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৭১ জন। শূন্য রয়েছে ৫ জনের পদ। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ আছে ৯৯টি। কর্মরত আছেন ৬৩ জন। শূন্য রয়েছে ৩৬টি পদ।

সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতিদিন সদর হাসপাতালে বহির্বিভাগে ৯০০ থেকে ১০০০ মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। আর ১০০ শয্যা থাকলেও প্রতিদিন হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকেন ৩২০ থেকে ৩৫০ জন। শয্যার তিন গুণ রোগী থাকার কারণে তাঁদের মেঝে ও বারান্দায় রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। যেসব রোগী ওয়ার্ডের মেঝে বা বারান্দায় থাকেন, তাঁদের হাসপাতাল থেকে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে না। ভর্তি হওয়া অতিরিক্ত রোগীদের নিজ দায়িত্বে খাবার ও বিছানা বাইরে থেকে আনতে হয়।

সোমবার সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ৩২০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। যাঁরা শয্যা পাননি, তাঁদের বিভিন্ন ওয়ার্ডের মেঝে, সিঁড়ি ও বারান্দায় রাখা হয়েছে। অনেক ডেঙ্গু রোগী ও শিশু রোগীদেরও মেঝেতে রাখা হয়েছে। সোমবার বহির্বিভাগে অন্তত ৮০০ রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন। 

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, কর্মরত ৩৫ জন চিকিৎসকের মধ্যে নিয়মিত ২-৩ জন  ছুটিতে, ৩-৪ জন প্রশিক্ষণে, ২-৩ জন রাত্রিকালীন দায়িত্ব পালনের বিশ্রামে থাকেন।  

চিকিৎসক–সংকটের কারণে যে স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হচ্ছে, সে কথা স্বীকার করেছেন সদর হাসপাতালের শিশুবিশেষজ্ঞ মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল নয়টায় হাসপাতালে এসে ভর্তি রোগীদের দেখতে হয়। সেখানে অন্তত দুই ঘণ্টা ব্যয় হয়। এরপর বহির্বিভাগে আসা রোগীদের দেখা শুরু করি। হাতে যে সময় থাকে, তাতে ২৫-৩০ জন রোগী দেখা সম্ভব। কিন্তু প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ জন রোগী দেখতে হচ্ছে। এতে রোগীদেরও পর্যাপ্ত সময় দেওয়া যায় না।