১৯ জুলাই বাবা তাজল কালের সঙ্গে পবিত্র জুমার নামাজ পড়তে বের হয়েছিল মোস্তফা জামান ওরফে সমুদ্র (১৭)। নামাজ শেষে রাজধানীর রামপুরায় ভাড়া বাসায় ফিরে যান বাবা। মোস্তফা জানিয়েছিল, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফিরবে। কয়েক ঘণ্টা পর সে বাড়ি ফিরেছে ঠিকই; তবে জীবিত নয়, লাশ হয়ে। পরিবারের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মোস্তফা নিহত হয়েছে।
মোস্তফার গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মধ্যপাড়া এলাকায়। মা-বাবার সঙ্গে সে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় থাকত। চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবসা শাখা থেকে জিপিএ-৪.৯৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় সে।
গত বৃহস্পতিবার মোস্তফার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বাড়ি শোকে স্তব্ধ। ঘরের বাইরে বসে আছেন তাঁর মা-বাবা। পাশেই বসে ছিলেন কয়েকজন স্বজন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মোস্তফার বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁরা কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এ সময় তাঁরা বারবার বলছিলেন, তাঁরা সরকারের পক্ষের মানুষ। তাঁরা সরকারের বিরুদ্ধে যায়—এমন কিছু বলবেন না।
পরিস্থিতি কিছুটা সামলে নিয়ে মোস্তফার মা মাসুদা জামান বলেন, ‘সেদিন (১৯ জুলাই) বাবা-ছেলে একসঙ্গে নামাজে বেরিয়েছিল। বরাবরের মতো ওর বাবা এক মসজিদে, পাশে আরেকটি মসজিদে বন্ধুদের সঙ্গে ছিল মোস্তফা। নামাজ শেষে ওর বাবা বাড়িতে চলে আসে। মোস্তফাকে সেদিন বেলা পৌনে তিনটার দিকে ফোন করে বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। ও বলেছিল, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা শেষে দুই মিনিট পর বাড়ি চলে আসবে। ছেলে বাড়ি না ফেরায় সাড়ে তিনটার দিকে আবারও ফোন করি। সে সময় আরাফাত নামের এক ছেলে ফোন ধরে বলল, মোস্তফা দূরে আছে, কাজ করছে। বিকেল চারটার দিকে আবারও ফোন করি, তখন আরাফাত জানায়, মোস্তফার গুলি লেগেছে। তাকে রামপুরার ডেলটা হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’
ছেলে মারা গেছে, মানতে পারিনি। সেখান থেকে বেটার লাইফ হাসপাতালে নিই। সেখানকার চিকিৎসকও জানান, মোস্তফা আর নেই। গোলাগুলির সময় কোথাও থেকে একটি গুলি এসে মোস্তফার হাতে লেগেছিল। সেটি হাত ভেদ করে পাঁজরে ঢুকে পড়ে। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মোস্তফার মৃত্যু হয়।মোস্তফার মা মাসুদা বেগম
মাসুদা বেগম বলেন, ‘ছেলে মারা গেছে, মানতে পারিনি। সেখান থেকে বেটার লাইফ হাসপাতালে নিই। সেখানকার চিকিৎসকও জানান, মোস্তফা আর নেই। গোলাগুলির সময় কোথাও থেকে একটি গুলি এসে মোস্তফার হাতে লেগেছিল। সেটি হাত ভেদ করে পাঁজরে ঢুকে পড়ে। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মোস্তফার মৃত্যু হয়।’
ছেলে হারানোর শোকের মধ্যেও আতঙ্ক কাটছেন না মোস্তফার বাবা তাজল কালের। নতুন করে আর কোনো ঝামেলায় পড়তে চায় না তাঁর পরিবার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ছেলে ফিরে পাব না। আমরা আর কোনো ঝামেলায় পড়তে চাই না। কারও বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। কার গুলি ছেলের লেগেছে, সেটাও জানি না।’
সেদিনের পরিস্থিতির বর্ণনায় মোস্তফার বাবা বলেন, ‘মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সপ্তম শ্রেণিতে পড়তাম। সে সময় যুদ্ধ দেখিনি। তবে ঢাকার সদরঘাটে ৮ থেকে ১০ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখেছিলাম। সহ্য করতে না পেরে গ্রামের বাড়ি চলে এসেছিলাম। ১৯ জুলাইও যুদ্ধ দেখেছি। নিজের ছেলেসহ একসঙ্গে হাসপাতালে লাশের দীর্ঘ সারি দেখেছি। মা-বাবা-স্বজনদের আহাজারি দেখেছি।’