‘ওর জন্য গোশত রান্না করেছিলাম, পরে শুনি গুলি খেয়ে মারা গেছে’

ছেলের মৃত্যুতে কান্না থামছে না আলেয়া বেগম ও ফরমান আলীর। গতকাল শুক্রবার রাতে পঞ্চগড় শহরের ইসলামবাগ এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

‘ছেলে বলেছিল “মা, আজ তো শুক্রবার। গরুর গোশত রান্না করিও।” গরুর গোশত আমার বাপধনের খুব পছন্দের। জুমার নামাজের আগে কিছুই খেয়ে বের হয়নি। ওরা বাপ-ছেলে একসঙ্গে জুমার নামাজে গেল। আমি ওর জন্য গোশত রান্না করেছিলাম। কিন্তু আমার ছেলেটা আর ফিরে এল না। পরে শুনি, আমার ছেলে গুলি খেয়ে মারা গেছে।’

মাঝরাতে ঘরের বিছানায় বসে ছেলের জন্য এভাবেই আহাজারি করছিলেন মা আলেয়া বেগম। স্বজনদের কেউ তাঁর পাশে বসে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আবার কেউ কেউ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিলেন। পঞ্চগড়ে গতকাল শুক্রবার আহমদিয়া জামাতের ‘সালানা জলসা’ বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন আলেয়া বেগমের ছেলে আরিফুর রহমান (২৮)।

স্বজনদের দাবি, গতকাল দুপুরে পবিত্র জুমার নামাজের পর শহরের মসজিদপাড়া এলাকায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাবের সংঘর্ষের সময় আরিফুরের মাথায় গুলি লাগে। ঘটনার সময় নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। তবে আরিফুরের মাথায় গুলি লাগার বিষয়টি অস্বীকার করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, ঘটনার সময় শুধু কাঁদুনে গ্যাসের শেল আর বারার বুলেট ছাড়া কোনো গুলি চালানো হয়নি।

আরিফুর রহমান

আরিফুর রহমান পঞ্চগড় শহরের মসজিদপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তবে কয়েক মাস ধরে মা-বাবাকে নিয়ে শহরের ইসলামবাগ এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকছিলেন তিনি। গতকাল দিবাগত রাত ১২টার দিকে আরিফুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কাফনের কাপড় মোড়ানো আরিফুরের নিথর দেহটা বারান্দায় রাখা হয়েছে। ছলছল চোখে পাশে বসে আছেন আরিফুরের বন্ধুরা।

ছোট ছোট তিন কক্ষের একটি টিনশেড বাড়ির একটি কক্ষের বিছানায় বসে আহাজারি করছিলেন আলেয়া বেগম। বারবার তিনি বলছিলেন, ‘একটামাত্র ছেলে আমার। ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। সব শেষ হয়ে গেল।’

স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দুই ভাই–বোনের মধ্যে আরিফুর ছোট। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে চাঁদপুর জেলায়। তাঁর পৌঁছানো সাপেক্ষে আজ শনিবার বেলা তিনটায় জানাজা শেষে জেলা শহরের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে আরিফুরের দাফন হবে।
আরিফুরের বাবা ফরমান আলী (৫৫) একটি পুরোনো কাপড়ের দোকানের কর্মচারী। মা আলেয়া বেগম (৫০) বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ করেন। একমাত্র ছেলে আরিফুরকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন ছিল মা–বাবার। ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কৃষি বিষয়ে ডিপ্লোমা শেষ করেন আরিফুর। চাকরির চেষ্টা করছিলেন। সংসারের অভাব ঘুচাতে স্বল্প বেতনে শহরের একটি ছাপাখানায় (প্রিন্টিং প্রেসে) কাজ করতেন আরিফুর।

অশ্রুসিক্ত চোখে আরিফুরের বাবা ফরমান আলী বলেন, ‘একমাত্র ছেলে আমার। খেয়ে না–খেয়ে বড় হয়েছে ছেলেটা। আমার আর কিছু থাকল না।’ বলতে বলতে একপর্যায়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। একটু থেমে বলতে শুরু করলেন, সকালে আরিফুর তাঁর মাকে গোশত রান্না করতে বলে বাইরে যান। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসেন। এরপর একসঙ্গে বাবা-ছেলে জুমার নামাজ পড়তে যান কেন্দ্রীয় মসজিদে। নামাজ শেষে ফরমান আলী বাড়ির দিকে আসেন। আরিফ বন্ধুদের সঙ্গে আরেক রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন।

বিক্ষোভ মিছিল করার সময় পুলিশ ও মুসল্লিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। শুক্রবার বেলা দুইটার পর পঞ্চগড় শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে

ফরমান আলী বলেন, ‘মসজিদপাড়ায় যেহেতু অনেক দিন ছিলাম, প্রতি শুক্রবার নামাজ শেষে আরিফ তাদের সঙ্গে দেখা করেই বাড়িতে আসে। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়ার কথা ছিল। ওর আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আমি খেয়ে নিলাম। বিকেলে শুনলাম আরিফের মাথায় গুলি লাগছে।’ আর বলতে পারছিলেন না ফরমান আলী। গলা ধরে আসে তাঁর।

স্বজন ও প্রতিবেশীরা জানান, গুরুতর আহত অবস্থায় আরিফুরকে উদ্ধার করে প্রথমে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন চিকিৎসক। পরে রংপুর নেওয়ার পথেই আরিফুর মারা যান।

উল্লেখ্য, পঞ্চগড় শহরের উপকণ্ঠে আহম্মদনগর এলাকায় আহমদিয়া জামাতের শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী জলসা বন্ধের দাবিতে গতকাল দুপুরে জুম্মার নামাজের পর পঞ্চগড় শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে মিছিল বের করা হয়। মিছিল নিয়ে বিক্ষোভকারীরা শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সমবেত হন। সেখান থেকে তাঁরা মিছিল নিয়ে করতোয়া সেতুর দিকে যেতে চাইলে পুলিশ তাঁদের থামিয়ে দেয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পড়েন।

কিছুক্ষণ পর চৌরঙ্গী মোড়সংলগ্ন সিনেমা হল সড়ক থেকে একদল বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে এসে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। তখন পুলিশ ধাওয়া দিলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। একদল বিক্ষোভকারী আহম্মদনগর এলাকায় গিয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তত ২৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় এ পাল্টাপাল্টি হামলা চলে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি ও র‍্যাবের সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছোড়েন। এ ঘটনায় দুজন নিহত ও পুলিশসহ অন্তত অর্ধশত মানুষ আহত হন। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আহমদিয়াদের জলসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।