যশোরে গুঁড়িয়ে দেওয়া স্বাধীনতা চত্বরে বিএনপি নেতাদের দোকান নির্মাণ

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার চিত্রা নদীর পাড়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে দোকান। গতকাল শুক্রবার
ছবি: প্রথম আলো

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার চিত্রা নদীর পাড়ে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে তৈরি করা হয়েছিল স্বাধীনতা চত্বর। পরে এই চত্বরেই নির্মাণ করা হয় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৫ আগস্ট ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ওই স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ।

পরদিনই সেই জায়গায় দখল করেন চারজন। তাঁরা সেখানে দোকান তুলছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দুই বিএনপি নেতা, একজন যুবদল নেতা আর অন্যজন বিএনপির কর্মী। স্বাধীনতা চত্বর ও স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙচুর এবং সেই জায়গায় দোকান নির্মাণ করায় উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

গতকাল শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার বাঘারপাড়া বাজারের মধ্য দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে চিত্রা নদী। নদীর দক্ষিণ তীরে চাড়াভিটা-নারিকেলবাড়িয়া সড়কের পাশে ছিল স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। সেখানে এখনো ধ্বংসস্তূপ রয়েছে। ওই সড়কের পাশে প্রায় ৬০ ফুট লম্বা দোকানঘর তোলা হয়েছে। প্রথমে ইট দিয়ে ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে। এরপর কংক্রিটের খুঁটি পোঁতা হয়েছে। টিন দিয়ে ছাউনি ও বেড়া দেওয়া হয়েছে। দোকানের কিছু অংশের চারপাশ এবং কিছু অংশের সামনে এখনো বেড়া দেওয়া হয়নি। দোকানঘরের পাশে পড়ে রয়েছে স্বাধীনতা চত্বরের টাইলসের ভাঙা খুঁটি।

প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজন বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে ৫ আগস্ট দুপুরের পর থেকে যশোরের বাঘারপাড়ায় উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন লোকজন। একপর্যায়ে মিছিল বের হয়। মিছিলে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও অংশ নেন। এ সময় উচ্ছৃঙ্খল লোকজন স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভে হামলা চালিয়ে তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেন।

এর পরদিন বাঘারপাড়া পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সদর উদ্দীন, তাঁর ফুফাতো ভাই বাঘারপাড়া পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি দাউদ হোসেন, বাঘারপাড়া পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর রহিম এবং বিএনপি কর্মী মহাসিন আলী ওই জায়গা দখলে নেন। ওই দিন তাঁরা বৈদ্যুতিক কাটার দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের লোহার রড কেটে ফেলেন। এরপর দোকানঘর তোলা শুরু করেন।

বিএনপি নেতা সদর উদ্দীন বলেন, ওই জমি আগে খাস ছিল। পরে তিনি সরকারের কাছ থেকে পাঁচ শতক জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত নেন। এরপর সেখানে তিনি এক তলা একটি পাকা ভবন নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ব্যবসা করেন। কিন্তু ২০০৬ সালে সরকার ওই জমি নিয়ে নেয়। তাঁর করা ভবনটি ভেঙে ফেলে। এরপর সরকার সেই জায়গায় প্রথমে স্বাধীনতা চত্বর এবং পরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। তিনি আরও বলেন, ‘সোমবার ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে দেয়। কেউ যাতে দখল না করতে পারে, সে জন্য আমি সড়ক ঘেঁষে একটি অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করেছি। পরে পুরো জায়গায় স্থায়ীভাবে ভবন নির্মাণ করব।’

যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার চিত্রা নদীর পাড়ে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছিল স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ। ভাঙচুরের আগে

৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি দাউদ হোসেন, সোমবার ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে দেন। তাঁরা চেষ্টা করেও ঠেকাতে পারেননি। এরপর ওই জায়গায় সদর উদ্দীন এবং আবদুর রহিম টিনের ঘর তুলেছেন। স্বাধীনতা চত্বরের বাইরে নদীর সঙ্গে কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল। জায়গাটা খাস। তিনি সেখানে কয়েকটি পিলার পুঁতে রেখেছেন। তাঁর (দাউদের) পাশে মহাসীন আলী ঘর তুলেছেন। এই নিয়ে কথা উঠলে তিনি সেখান থেকে পিলারগুলো সরিয়ে নেবেন।

উপজেলার কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, ২০০৯ সালে উপজেলা প্রশাসন চিত্রা নদীর পাড়ে মাটি ভরাট করে স্বাধীনতা চত্বর তৈরি করে। তখন থেকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবছর মহান স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে স্বাধীনতা চত্বরে ফুল দিয়ে বীর শহীদদের স্মরণ করতেন। সাধারণ মানুষও সেখানে শ্রদ্ধা জানাতেন। ২০১৮ সালে উপজেলা প্রশাসন স্বাধীনতা চত্বরে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। সেখানে উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের ফলক ছিল। সে স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে দেওয়া এবং সেখানে দোকান নির্মাণ করায় তাঁরা হতবাক ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

বাঘারপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান আলী বলেন, ‘স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থান। হামলা চালিয়ে সেটি ভেঙে ফেলায় হতবাক হয়েছি। ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ভাঙা এবং সেখানে দোকান নির্মাণের নিন্দা জানাই। যাঁরা এসব করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া এবং শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’

বাঘারপাড়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শামছুর রহমান বলেন, কিছু লোকের খারাপ কাজের জন্য দলের বদনাম হবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। যাঁরা স্বাধীনতা চত্বর ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভের জায়গায় দোকান নির্মাণ করেছেন, তাঁদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, দ্রুত দোকান ভেঙে সরিয়ে নিতে। আজ শনিবারের মধ্যে দোকান সরিয়ে না নিলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।