অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করে দ্রুত টাকা আয় করতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন রাজশাহীর মানুষ। নানা লোভনীয় ‘অফার’ নিয়ে একের পর এক অ্যাপ আসছে, আর সেখানে বিনিয়োগ করছেন মানুষ। রাতারাতি ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা আইনের আশ্রয় না নেওয়ায় প্রশাসনও কিছুই জানতে পারছে না।
সর্বশেষ ‘চীনা অ্যাপ ই-মুভি’ প্ল্যাটফর্ম থেকে ডলার আয় করতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। অ্যাপের মাধ্যমে সিনেমার টিকিট কিনে ডলার আয় করার প্রলোভন নিয়ে এসেছিল ‘ই-মুভি’। গত রোববার এই অ্যাপের বিনিয়োগকারী ব্যক্তিদের ‘ব্যালেন্স’ শূন্য হয়ে যায়।
এই অ্যাপগুলো হেরোইনের নেশার মতো। একবার যে করেছে, নতুন অ্যাপ আসার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার সেটাতে বিনিয়োগ করবেই। তাঁকে নিষেধ করলেও শুনবে না। এই ধরনের অ্যাপ আসতেই আছে।শহিদুল ইসলাম, চৈতন্যপুর, গোদাগাড়ী, রাজশাহী
ন্যূনতম দুই হাজার টাকা দিয়ে হিসাব নম্বর খুলে ‘চীনা অ্যাপ ই-মুভি’তে বিনিয়োগ করেছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। গত অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে রাজশাহীর বিভিন্ন গ্রামে পর্যন্ত এই অ্যাপ যুবসমাজের মধ্যে ঝড় তুলেছিল। কোনো কাজ না করে রাতারাতি ধনী হওয়ার জন্য তাঁরা বেশি টাকা দিয়ে হিসাব নম্বর খুলে বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। এ কার্যক্রম চালানোর জন্য রাজশাহী নগরের সিরোইল কলোনিতে একটি কার্যালয় খোলা হয়েছিল। মঙ্গলবার থেকে ওই কার্যালয়েও তালা ঝুলছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত আগস্টে ‘সিএএফ’ নামের একটি অ্যাপে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামের মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। এই অ্যাপ ছিল আন্তদেশীয় ফুলবল খেলা নিয়ে। বিকাশের মাধ্যমে এই অ্যাপে টাকা জমা করার নিয়ম ছিল। একটি করে খেলার পর জমানো টাকার ওপর মুনাফা জমা হচ্ছিল। প্রথম দিকে যাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁরা মুনাফা তুলে নিয়েছিলেন। শেষের দিকে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। গ্রামটির বেশির ভাগ মানুষ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর। তাঁরাও এতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছিল চৈতন্যপুর গ্রামের শহিদুল ইসলাম নামের এক যুবক স্থানীয়ভাবে এই অ্যাপটি পরিচিত করেছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি অ্যাপটি মানুষের বিনিয়োগ নিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। সেই সময় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শহিদুল ইসলামের সঙ্গে কিছুতেই যোগাযোগ করা যায়নি। তার সব কয়টি ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। বাড়িতে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরাও মুখ খুলেননি।
গতকাল বুধবার সকালে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে শহিদুল ইসলাম ফোন ধরেন। তিনি বলেন, ফুটবল খেলা নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে ‘সিএএফ’ নামের অ্যাপটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরই ইচ্ছা করেই তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেননি। তাঁর ভাষায় তখন ‘পরিবেশ খুব গরম ছিল’। তাঁর দাবি, তিনি ওই অ্যাপ চালুর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। ওটা ছিল জুয়া খেলার মতো। আগে তিনি সব ধরনের নেশা করতেন। গত চার বছর থেকে নেশার জগৎ ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। কোনো ধরনের জুয়ার সঙ্গে তিনি থাকেন না। আগে যেহেতু ডেসটিনি করতেন তাই লোকজন মনে করেছিলেন যে তিনিই এই অ্যাপ এনেছিলেন।
শহিদুল ইসলাম বলেন, এখন সবার হাতে স্মার্টফোন। নতুন কোনো অ্যাপ এলে কাউকে বলে দিতে হচ্ছে না। সিএএফ বন্ধের পরে সিনেমার টিকিট কিনে ডলার আয় করার সুযোগ নিয়ে এসেছিল ই-মুভি অ্যাপ। তিনি খবর রাখেন ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর মতে, এই অ্যাপগুলো হেরোইনের নেশার মতো। একবার যে করেছে, নতুন অ্যাপ আসার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার সেটাতে বিনিয়োগ করবেই। তাঁকে নিষেধ করলেও শুনবে না। এই ধরনের অ্যাপ আসতেই আছে।
শহিদুল ইসলাম জানান, নিষেধ করার পরও সিএএফ অ্যাপে তাঁর ছোট ভাই বিনিয়োগ করেছিলেন। সে প্রথম দুই দফায় ২৫ হাজার করে ৫০ হাজার টাকা মুনাফা তুলেছিলেন। পরে যখন অ্যাপটি বন্ধ হয়ে গেল তখন তাঁর ৬০ হাজার টাকা খোয়া যায়। তাঁর মতে, যাঁরা প্রথম দিকে টাকা জমা করেছিলেন, তাঁরা লাভবান হয়েছেন। পরের বিনিয়োগকারী ব্যক্তিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহেল রানা বলেন, ইউনিয়নের প্রেমতলী, খেতুর, ডুমুরিয়া ও তাঁর ইউনিয়নের সীমান্তের ফরহাদপুর গ্রামের বাড়ি বাড়ি এই অ্যাপ ছড়িয়ে পড়েছে। এলাকার চার যুবক এটা ছড়িয়েছেন। তাঁরা লাভবান হয়েছেন। বাকিরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল হাসান বলেন, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানে না। প্রথম শুনছেন। কেউ কোনো অভিযোগ করতেও আসেননি।
‘চীনা অ্যাপ ই-মুভি’র প্রচার শুরু করেছিলেন রাজশাহী নগরের সিরোইল কলোনি এলাকার সাড়ে ৩ নম্বর গলির মানিক নামের এক ব্যক্তি। কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে পালানো মানিকের কোনো খোঁজ মেলেনি।
‘চীনা অ্যাপ ই-মুভি’র বিষয়ে নগরের বোয়ালিয়া থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, সারা দিনে কেউ কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেনি। একটা মামলা না হলে অপরাধীরা আইন আদালতের বাইরেই থেকে যাবে। তিনি বলেন, এটা কয়েক কোটি টাকার জালিয়াতি। কেউ না কেউ মামলা করবেন বলে তিনি আশা করছেন।