‘চাইর দিন ধইরা বাড়িঘরে পানি। রান্দুনের কোনো বাও নাই। বাজার থাইকা শুকনা খাওন আইনা কোনো রহম দিন কাডাইতাছি। দুঃখের বিষয় অইল, এই পর্যন্ত কোনো ত্রাণ পাইলাম না। কেউ খোঁজ নিল না।’ বাড়ি থেকে বুকপানি ভেঙে এসে আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার উত্তর নাকশী গ্রামের আলেয়া বেগম (৫২)। এ সময় ভেজা শরীরে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর স্বামী রফিজ হক।
এই অভিযোগ শুধু আলেয়া বেগমের একার নয়, তাঁর মতো উপজেলার মরিচপুরান, যোগানিয়া ইউনিয়নের অনেকেই ত্রাণ না পাওয়ার আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন। গতকাল রোববার থেকে আজ সোমবার পর্যন্ত যোগানিয়া, মরিচপুরান, কলসপাড় ও রাজনগর ইউনিয়নের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। রাতে হালকা বৃষ্টি হলেও সকাল থেকে রোদ রয়েছে।
যোগানিয়া বাল্লাকান্দা গ্রামের নিলুফা বেগম (৪০) বলেন, ‘এখনো ঘরে পানি। চার সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা ত্রাণ পাই নাই। কেউ আসেও নাই। আমরা রাস্তার পাশে, তাই কেউ আমগরে মূল্যায়ন করে না।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুদ রানা বলেন, উপজেলায় আজ পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। চার দিনে এ পর্যন্ত ২৬ হাজার পরিবারকে রান্না করা খিচুড়ি ও শুকনা খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি না পেয়ে থাকেন, অবশ্যই খোঁজ নিয়ে দ্রুত তাঁদের সহযোগিতা করা হবে।
উপজেলায় ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে সৃষ্ট বন্যায় ১৯৮৮ সালের চেয়েও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠদের দাবি। তবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সেই তুলনায় জাতীয়ভাবে সহযোগিতার তৎপরতা নেই বলে অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা। এমনকি প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো ত্রাণ সহযোগিতা পৌঁছায়নি বলে অনেকেই দাবি করেছেন।
উপজেলা প্রশাসন, ভুক্তভোগী এলাকাবাসী ও বিভিন্ন সংস্থা সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে ভারী বৃষ্টি এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে আসা ভোগাই ও চেল্লাখালী নদ–নদীতে পাহাড়ি ঢল নামে। এ সময় নদ–নদী দুটির বিভিন্ন অংশ ভেঙে ও বাঁধ উপচে ঢলের পানিতে উপজেলার পোড়াগাঁও, নয়াবিল, নন্নী, রামচন্দ্রকুড়া, বাঘবেড় ইউনিয়ন ও পৌর এলাকা প্লাবিত হয়। গত শনিবার রাত থেকে উজানের পানি নিম্নাঞ্চল যোগানিয়া, মরিচপুরান, কলসপাড় ও রাজনগর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত করেছে। আজ দুপুর পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। এই বন্যায় ৩১ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি নিম্নাঞ্চলে নেমে গেলেও এখন পর্যন্ত ৬৬ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। বন্যার কারণে জেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে ১২৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ১৮টি মাদ্রাসা, ৩২টি উচ্চবিদ্যালয় ও ৩টি কলেজ বন্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে, ১৯ হাজার হেক্টর আমন ও ১৫০ হেক্টর সবজির খেত তলিয়ে আছে। বন্যার্ত ব্যক্তিদের সহযোগিতা করতে উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কাজ করে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৬ হাজার পরিবারের কাছে খাবার, বিশুদ্ধ পানি, খিচুড়িসহ বিভিন্ন সহযোগিতা করা হয়েছে।
স্থানীয় লোকজন বলেন, এই সহযোগিতা অপ্রতুল। যেভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেভাবে উচ্চপর্যায়ের সহযোগিতা আসেনি। দেশের অন্যান্য জেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় বিভিন্ন সংস্থা, উদ্যোক্তা, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী এবং জাতীয়ভাবে যে সহযোগিতা করা হয়েছে, শেরপুর তথা নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতীর বন্যায় সে রকম সহযোগিতা করা হয়নি বলে দাবি করছেন ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা।
ইউএনও মাসুদ রানা বলেন, উপজেলায় বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও সেই তুলনায় কিন্তু সহযোগিতা অপ্রতুল। সরকারি-বেসরকারি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ত্রাণের কাজ অব্যাহত রয়েছে। ৩টি ইউনিয়নে ৪৬টি আশ্রয়ণকেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়ণকেন্দ্রে ১৮ হাজার ৩৫ জন আশ্রয় নিয়েছেন। চারটি ইউনিয়নে অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দী হলেও তাঁরা নিজ বাড়িঘর ছেড়ে আসতে চান না। তাই এই উপজেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণের প্রয়োজন রয়েছে।