চলন্ত সিঁড়িগুলো ছিল নতুন, পলিথিনে মোড়ানো। নির্দিষ্ট স্টেশনে স্থাপনের জন্য রাখা হয়েছিল সড়কের ওপর। এর মধ্যেই ছাত্র–জনতার আন্দোলনে পুড়ে যায়।
মূল সড়কের মাঝবরাবর সোজা চলে গেছে বাস চলাচলের পৃথক লেনটি। সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে এস্কেলেটর বা চলন্ত সিঁড়ির ২০ থেকে ২৫টি খণ্ডিত অংশ। কোনোটি পুরোপুরি, কোনোটি আংশিক পোড়া, কোনোটি ভাঙচুর করা। ঘটনার সাড়ে তিন মাস পরও এগুলো রাস্তায় পড়ে আছে। নেই পাহারা, নেই কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী।
১৯ নভেম্বর দুপুরের এ চিত্র বিআরটি প্রকল্পের উত্তরা-টঙ্গী উড়ালপথের উত্তরা সাইদগ্র্যান্ড সেন্টার এলাকার। গত জুলাই–আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে প্রকল্পের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। পুড়িয়ে দেওয়া হয় প্রকল্পের বিভিন্ন স্টেশনের জন্য রাখা চলন্ত সিঁড়ি। পাশাপাশি ভাঙচুর করা হয় লিফট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। ঘটনার সাড়ে তিন মাস পরও সড়কের বিভিন্ন অংশে সেসব ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
আন্দোলনে আমাদের যেসব মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার একটি তালিকা দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেখানে মালামাল বাবদ একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। আমরা সেসব যাচাই-বাছাই করে দেখছি। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত মালামালগুলোর কোনোটি ব্যবহারযোগ্য কি না বা ক্ষতির পরিমাণ কী, সেটাও দেখা হচ্ছে।প্রকল্পের পরিচালক (সওজ) রেজাউল করিম
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানায়, ছাত্র–জনতার আন্দোলনে প্রকল্পের ৪৪টি চলন্ত সিঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে প্রকল্পের বিবিএ অংশে (সেতু বিভাগ) ৬টি ও সওজের (সড়ক বিভাগ) অংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৮টি চলন্ত সিঁড়ি। এসব সিঁড়ির কোনোটি পুরোপুরি, কোনোটি আংশিক আগুনে পুড়ে গেছে। এর বাইরে সওজ ও বিবিএ—দুই অংশের ২৯টি লিফট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানায় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে প্রকল্পের পরিচালক (সওজ) রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলনে আমাদের যেসব মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার একটি তালিকা দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেখানে মালামাল বাবদ একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে। আমরা সেসব যাচাই-বাছাই করে দেখছি। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত মালামালগুলোর কোনোটি ব্যবহারযোগ্য কি না বা ক্ষতির পরিমাণ কী, সেটাও দেখা হচ্ছে।’
■ প্রকল্পের ৪৪টি চলন্ত সিঁড়ি, ২৯টি লিফট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ও ভাঙচুর করা হয়েছে। এখন এগুলোর যন্ত্রাংশ চুরি হচ্ছে। ■ ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে প্রকল্পের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। ■ সবচেয়ে বেশি আগুনে পোড়া ক্ষতচিহ্ন দেখা যায় প্রকল্পের উত্তরা-টঙ্গী উড়ালপথ ও আজমপুর এলাকায়।
প্রকল্পটির দৈর্ঘ্য ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এটি ঢাকার বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের শিববাড়ি পর্যন্ত বিস্তৃত। এর অধীন সড়কের মাঝখান দিয়ে দুই লেনের বাসের পথ তৈরি করা হবে, যা একটি বেড়া দিয়ে আলাদা থাকবে। যাত্রী ওঠানামার জন্য পথে থাকবে ২৪টি স্টেশন। আর প্রতিটি স্টেশন ব্যবহারের জন্য থাকবে তিনটি লিফট ও চারটি চলন্ত সিঁড়ি। প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, স্টেশন স্থাপনের জন্য পাঁচ–ছয় মাস আগে সিঁড়িগুলো রাখা হয়েছিল সড়কের ওপর। প্রতিটি সিঁড়ি ছিল নতুন, পলিথিনে মোড়ানো। গত ১৮ জুলাই উত্তরায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উড়ালপথের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাস ও চলন্ত সিঁড়িতে আগুন দেয়।
১৯ নভেম্বর দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গীর কলেজ গেট পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেশনে এরই মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে চলন্ত সিঁড়ি। তবে এর মধ্যে বেশির ভাগ স্টেশনের সিঁড়িই ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের শিকার। সিঁড়িগুলো এখনো পড়ে আছে বিধ্বস্ত অবস্থায়। এর বাইরে কলেজ গেট থেকে উত্তরার জসীমউদ্দীন পর্যন্ত বিআরটির উড়ালপথ ও সড়কের বিভিন্ন অংশে চলন্ত সিঁড়িগুলো স্থাপন করা হয়নি। এসব সিঁড়ির সব কটিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সবচেয়ে বেশি আগুনে পোড়া ক্ষতচিহ্ন দেখা যায় প্রকল্পের উত্তরা-টঙ্গী উড়ালপথ ও আজমপুর এলাকায়। উড়ালপথের সাইদগ্র্যান্ড সেন্টারের সামনে বিআরটি লেনের (মাঝখানের সোজা পথ) বিভিন্ন অংশে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে চলন্ত সিঁড়ির প্রায় ২৫টি অংশবিশেষ। এগুলোর সবই আগুনে পোড়া। সেখান থেকে একটু দক্ষিণে এগোলে আজমপুর পদচারী–সেতুর নিচে তিনটি চলন্ত সিঁড়ি পড়ে থাকতে দেখা যায়। সিঁড়িগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। কোনোটি আংশিক আগুনে পোড়া। তবে প্রতিটি সিঁড়ি থেকেই কিছু না কিছু মালামাল বা যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যেতে দেখা গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, স্টেশন স্থাপনের জন্য পাঁচ–ছয় মাস আগে সিঁড়িগুলো রাখা হয়েছিল সড়কের ওপর। প্রতিটি সিঁড়ি ছিল নতুন, পলিথিনে মোড়ানো। গত ১৮ জুলাই উত্তরায় পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উড়ালপথের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাস ও চলন্ত সিঁড়িতে আগুন দেয়। এর পর থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলন্ত সিঁড়ি ও লিফটের যন্ত্রাংশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
কথা হয় উড়ালপথ–সংলগ্ন বিডিআর মার্কেটের স্থানীয় দোকানি মো. ইউসুফের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলনের পর থেইক্যাই সিঁড়িগুলো পড়ে আছে রাস্তার ওপর। দেখভালের কেউ না থাকায় প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই কিছু ভবঘুরে সিঁড়ির বিভিন্ন জিনিসপত্র খুলে নিয়ে যায়।’
আন্দোলনের আগে আমাদের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ছিল প্রায় ৯৭ শতাংশ। বড় কাজের মধ্যে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি উড়ালপথ আর স্টেশনের সিঁড়ি স্থাপনসহ ছোটখাটো কাজ বাকি ছিল। এর মধ্যে আন্দোলন শুরু হলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে।প্রকল্পের সদ্য বিদায়ী পরিচালক (সেতু অংশ) মহিরুল ইসলাম
হামলা-ভাঙচুরের পর থেকে প্রকল্পের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে। ১২ থেকে ১৯ নভেম্বর সরেজমিন কোথাও সেভাবে প্রকল্পের কাজ চলমান দেখা যায়নি। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত সিঁড়িগুলো প্রতিস্থাপন না করায় বা মেরামতের সুযোগ না থাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে নির্দিষ্ট সময় প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।
প্রকল্পের সদ্য বিদায়ী পরিচালক (সেতু অংশ) মহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলনের আগে আমাদের কাজের সার্বিক অগ্রগতি ছিল প্রায় ৯৭ শতাংশ। বড় কাজের মধ্যে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি উড়ালপথ আর স্টেশনের সিঁড়ি স্থাপনসহ ছোটখাটো কাজ বাকি ছিল। এর মধ্যে আন্দোলন শুরু হলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা চলছে।’