ঘূর্ণিঝড় রিমাল

‘আমগোরে কি এট্টু জাগা, এট্টা ঘর দেওন যায় না’

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ভোলার বোরহানউদ্দিনে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর, গাছপালা। গতকাল বুধবার বিকেলে উপজেলার হাসাননগর ইউনিয়নের সুধারামপুর গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

ভোলার বোরহানউদ্দিনের জেলে মো. ইউসুফের (৪৯) ঘরটি কাত হয়ে পড়ে আছে। ১২-১৩টি খুঁটির ওপর টিনের চাল থাকলেও নিচে না আছে ভিটের মাটি, না আছে বেড়া। গতকাল বুধবার বিকেলে উপজেলার হাসাননগর ইউনিয়নের সুধারামপুর গ্রামে এ দৃশ্য দেখা যায়।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে গত সোমবার এই দশা হয়। গ্রামে বাঁধের বাইরে এই বসতঘরটি। ঘরের হাঁড়ি-পাতিল, আসবাবপত্র সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ভাঙা খাটের কাঠের দুটি টুকরা অদূরে কাদামাটির মধ্যে পড়ে আছে। পানি নেমে শুকিয়ে যাওয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আসবাব কুড়িয়ে জমা করতে দেখা যায় ইউসুফকে। তাঁর পরিবারে তিনিসহ সাতজন সদস্য। বাকি সবাইকে অদূরে কাজিরহাট এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখেছেন। ঘর দাঁড় করাতে পারলে আবার নিয়ে আসবেন। নইলে এটা ভেঙে অন্যত্র নিয়ে যাবেন। ইউসুফ বলেন, ‘তবে এ এলাকা আর বসবাসযোগ্য নেই। পানির ঢেউয়ে সব গভীর খাদ হয়ে গেছে।’

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ঘর বিধ্বস্ত হয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন এই ব্যক্তি। গতকাল বুধবার বিকেলে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার সুধারামপুর গ্রামে

ইউসুফ জানান, তাঁর সংসার চলে গলদা চিংড়ির রেণু ধরে। একটি রেণু ধরতে পারলে ১২ পয়সা পাওয়া যায়। তা–ও বিক্রির পরে দাম দেয় মহাজন। বর্ষায় ইলিশের নৌকায় মাছ ধরতে যান গভীর নদী ও সাগর মোহনায়। এই আয়ে কীভাবে কী করবেন, দিশাহারা তিনি। বলেন, ‘ই ঘর দাঁড় করাইতে কম করি বিশ-তিরিশ হাজার নামি যাইব, গাড়িত চা খাওনের টিয়া নাই।’

ইউসুফের মতো সুধারামপুরের বাঁধের বাইরের মানুষগুলো অনেকটাই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। ঘরহারা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এত্তো মাইনষে প্রধানমন্ত্রীর ঘর পায়, আমরা যারা বান্দের উরপে, বান্দের বাইরে নিত্য ঝড়-বন্যা, জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের লগে যুদ্দ করি, আমগোরে কি এট্টু জাগা, এট্টা ঘর দেওন যায় না...।’

জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ আছড়ে পড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মাটি ধসে গেছে। গতকাল বুধবার বিকেলে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার সুধারামপুর গ্রামে

সুধারামপুরের কাটাখালী খালের পাশে ৩০ বছর আগের পরিত্যক্ত মাটির বাঁধের ওপর ২০ ঘর ভাঙনকবলিত মানুষের বাস ছিল। রিমাল তাঁদের প্রত্যেকের ভিটেমাটি ধুয়ে নিয়ে গেছে। ঘর হারিয়ে তাঁরা বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে বারান্দায় রাত কাটাচ্ছেন। এ বাঁধের ওপর বসবাস করা রফিকুল ইসলাম মাঝি ও মো. শাহিন মাঝি জানান, সোমবার সন্ধ্যার জোয়ারে তাঁদের ঝুপড়ি দুমড়েমুচড়ে যায়। সেই সঙ্গে ভেসে যায় ঘরের আসবাব। ঘরের চালার ওপর গাছ শেকড়সুদ্ধ উপড়ে এসে পড়ে। ভাগ্য ভালো যে ঘরে কেউ ছিল না।

সরেজমিনে দেখা যায়, জলোচ্ছ্বাসের পানি নেমে গেছে। নদীর চরে আটকে পড়ে আছে আমগাছ, কাঁঠাল, তাল, মেহগনিগাছ, ঘরের চাল, জেলে নৌকার জাল, লাল বালু, পাথর। ভাঙনকবলিত হাসাননগর ইউনিয়নের বাঁধের বাইরে মেঘনা নদীর জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ আছড়ে পড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের মাটি, ফলের গাছ, পুকুরের মাছ, তীরসংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণকাজের মালামাল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ঠিকাদারের সাইটে কাজ করেন স্থানীয় লোকজন। তাঁরা ওই সব মাল সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে ঘরটি কাত হয়ে পড়ে আছে। গতকাল বুধবার বিকেলে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার সুধারামপুর গ্রামে

বাঁধের নির্মাণকাজ করছে এসএম জয়েন্ট ভেঞ্চার নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর কর্মী মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, তাঁদের মালিকের প্রায় ৭০ লাখ টাকার সিমেন্ট, বালু, পাথর নষ্ট হয়ে গেছে। শ্রমিকেরা যেখানে বসবাস করতেন, সে ঘরটিও ভেঙে গেছে। নদীর তীরে পাহাড়সমান উঁচু করে রাখা সিমেন্টের বস্তা সব পাথর হয়ে গেছে।

হাসাননগর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সচিব প্রবীর কুমার দে বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে তাঁদের ইউনিয়নের ২১টি বসতঘর সম্পূর্ণ, ১১০টি বসতঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা, ৪০ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ, তীর সুরক্ষা ব্লক বাঁধের মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক ব্লক ও বস্তা তীর ভেঙে নদীতে পড়েছে। ২০টি মাছের পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। প্রায় ২০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে।

হাসাননগর ইউপি চেয়ারম্যান আবেদ চৌধুরী বলেন, তাঁরা তিন মেট্রিক টন জিআর চাল পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার (আজ) বিতরণ হবে। তবে বাঁধের বাইরে বসবাস করা মানুষগুলো খুবই অসহায়। তাঁদের নিজস্ব এক টুকরা জমি বা একটি পাকা ঘর দরকার।