চুয়াডাঙ্গায় অর্থের অভাবে অস্ত্রোপচার হয়নি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত কিশোরী সোনিয়া খাতুনের। গতকাল শুক্রবার রাতে সোনিয়ার শরীরে অস্ত্রোপচার করার কথা ছিল। তবে প্রয়োজনীয় টাকার জোগান দিতে না পারায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সোনিয়ার অস্ত্রোপচার করেনি।
সোনিয়ার খালু বিল্লাল হোসেন বলেন, অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। অস্ত্রোপচারসহ চিকিৎসার জন্য ৫০ হাজার টাকার বেশি লাগবে। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ নিয়ে তাঁদের অনিশ্চয়তা কাটেনি।
গত বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সোনিয়ার স্বামী শামীম হোসেন (২২) মারা গেছেন। ওই মোটরসাইকেলে থাকা সোনিয়া গুরুতর আহত হয়েছে। সোনিয়া স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। নিহত শামীম বেগমপুর ইউনিয়নের ফুরশেদপুর গ্রামের নওদাপাড়ার মৃত শফিউদ্দিনের ছেলে। বর্তমানে সোনিয়া চুয়াডাঙ্গার নিউ ইউনাইটেড ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। স্বামী শামীম হোসেন মারা যাওয়ার পর প্রায় ৪০ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও খবরটি জানে না সোনিয়া।
সোনিয়ার শ্বশুববাড়ির লোকজনের আর্থিক অবস্থাও ভালো নয়। এ অবস্থায় হাসপাতালের শয্যায় থাকা মেয়েকে নিয়ে সাহায্যের আশায় সময় পার করছেন সোনিয়ার স্বজনেরা। এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে দিশাহারা শামীম হোসেনের মা বুলবুলি খাতুন।
সোনিয়ার মামা ভ্যানচালক খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘চিকিৎসার খরচ জুগার করার চেষ্টা করা হচ্চে। মানুষজনের কাচে হাত পাইতপো (পাতব), দেখি কী হয়! এখনো শামীমের মৃত্যুর খবর জানানো হয়নি সোনিয়াকে। তবে, কতক্ষণ গোপন রাখতি পারা যাবে, সেটাই প্রশ্ন।’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি শামীমের সঙ্গে সোনিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের দিন স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিল সোনিয়া। এলাকার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি আবার নববধূকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসেন শামীম। গতকাল সোনিয়াকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফেরার কথা ছিল শামীমের। কিন্তু তার আগেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন শামীম।
আজ শনিবার সকালে চুয়াডাঙ্গা জেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ফুরশেদপুর গ্রামের নওদাপাড়ায় গিয়ে কথা হয় শামীমের স্বজনদের সঙ্গে। মেঠো পথের ধারে শুকনা কলাপাতায় ঘেরা বাড়িজুড়ে এখন শুধুই মাতম। অথচ কয়েক দিন আগেই পরিবারে নতুন সদস্য যোগ হওয়ায় বাড়িজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। সেই বাড়িতে এখন নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
শামীমের স্বজনেরা বলেন, ১৫ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন শামীমের মা বুলবুলি খাতুন। স্বামীর মৃত্যুর পর কঠোর সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়েছেন তিনি। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে সন্তানদের খাবার জুগিয়েছেন। দুই মেয়ে স্বপ্না খাতুন ও সুমী খাতুনকে বিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ে স্বপ্নার বছর পাঁচেক আগে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। তখন থেকে এক সন্তান নিয়ে স্বপ্না মায়ের বাড়িতে থাকেন। স্বপ্নার ছেলে শিপনের বয়স এখন ১২ বছর। সে স্থানীয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। চার সদস্যের সংসারে মূল উপার্জনকারী ছিলেন শামীম। হঠাৎ করে শামীমের মৃত্যুর পর গোটা পরিবারে চরম অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে।
বুলবুলি বলেন, ‘আমার মানিক সাত বচর ধইরে সুংসার চালায়। সুংসারে ককোনো ভাত-কাপুড়ির অভাব হয়নি। বড় মেয়ের ছেলের পড়াশুনার জন্যি বই-খাতা, স্কুলির খরজ ও প্রাইভেট পড়ার খরজ সবই দিত শামীম। ছেলেডার বিয়ে দিয়ে সুংসারডা যকন গুচাইনো শুরু করলাম, তকন আল্লাহ আমার সুনাডারে তুলে নিল। এট্টা এক্সিডেন্ট সবকিছু তচনচ করে দিল। সামনে চোকে খালি অন্দকার দেকচি।’
প্রতিবেশী লালবানু বেগম বলেন, ‘ছেলে তো মরেই গিয়েচে। বিটার বউয়ের চিকিস্যা করানোর জন্যি যে কিচু ট্যাকা দেবে, সে সামথ্য নেই ইগের।’ এ সময় পাশে দাঁড়ানো আরেক নারী বলেন, ‘শুক্কুরবার আমার কাচ থিইকে ট্যাকা ধার কইরে মা-মেয়েতে (বুলবুলি আর স্বপ্না) হাসপাতালে গিয়েলো শামীমের বউর দেকতি।’
সোনিয়াকে আবার কবে হাসপাতালে দেখতে যাবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে বুলবুলি বলেন, ‘দেকি, কুতাও ট্যাকাপয়সা পাওয়া যায় কি না। বাড়িত্তি হাসপাতালে যাতি একজনেরই লাগে ২০০ ট্যাকা। সেই ট্যাকাও হাতে নেই। বউমার চিকিস্যার ট্যাকার জন্যিও ট্যাকা দিয়া দরকার। কনে পাবো, কার কাচে যাবো, বুজে উটতি পারচিনে।’