জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় আয় আগের থেকে অনেক কমেছে। কিন্তু এটা তাঁদের আদি পেশা, তাই এই পেশা পরিবর্তন করতে পারছেন না।
আবদুল হামিদ মল্লিকের বয়স ৬৭ বছর। স্ত্রী, দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়েসহ ৯ সদস্যের সংসার। বাবা শামসুদ্দিন মল্লিকের সূত্র ধরে হামিদ মল্লিকের প্রধান পেশা কাপড় বোনা। নিজ বাড়িতে বসিয়েছেন তাঁতযন্ত্র। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এখন বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সাহায্যে কাপড় বোনেন। বাড়িতে লুঙ্গি ও গামছা তৈরি করেন।
দিন দিন জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায় মন্দা চলছে। খরচের তুলনায় লাভের পরিমাণ নগণ্য। তাই সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে হামিদের। হামিদ রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার শরিষা ইউনিয়নের বহলাডাঙ্গা কারিগর পাড়ার বাসিন্দা। হামিদের মতো তাঁর গ্রামের আরও ১০০ পরিবার তাঁতের সঙ্গে জড়িত। সবাই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।
হামিদ বলেন, তাঁর পরিবারের সবাই এই কাজ করেন। জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় আয় আগের থেকে অনেক কমেছে অথচ খরচ বেড়েছে। কিন্তু এটা তাঁদের আদি পেশা, তাই এই পেশা পরিবর্তন করতে পারছেন না।
পাংশা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বহলাডাঙ্গা কারিগরপাড়া। বহলাডাঙ্গা কারিগরপাড়া ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলার সময় কানে আসে তাঁতের ঠুকঠুক শব্দ। অধিকাংশ বাড়ির বসতভিটায় বসানো বৈদ্যুৎচালিত তাঁতযন্ত্র। প্রতিদিন ভোররাত থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলে এসব যন্ত্র। সামর্থ্য অনুযায়ী এক থেকে দুটি করে যন্ত্র বসানো রয়েছে।
হামিদ মল্লিক বলেন, এখন তাঁরা বৈদ্যুতিক যন্ত্রের সাহায্যে লুঙ্গি তৈরি করছেন। গামছাটি হাতযন্ত্রের সাহায্যেই বুনছেন। দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আবদুল মতিন বাড়িতে লুঙ্গি আর গামছা বোনেন। আর হামিদ মল্লিক ঢাকার সাভার থেকে এলাকায় ঘুরে ঘুরে গামছা ও লুঙ্গি বিক্রি করেন। প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত তাঁর লাভ হয়। আগে সারা দিন বেচাবিক্রি শেষে যা লাভ হতো, তা দিয়ে মোটামুটি এত বড় সংসারে ভালোই কেটে যেত। কিন্তু থাকার ঘর ভাড়া, নিজের খাওয়াদাওয়াসহ অন্য খরচ মিলে ঠিকমতো পোষাতে পারছেন না তিনি।
আবদুল মতিন বলেন, প্রতিদিন খুব ভোরে উঠেই তাঁতযন্ত্র চালু করতে হয়। এর পাশাপাশি তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে লুঙ্গি কিনে নিজের তৈরি লুঙ্গির সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসা করছেন। বাড়িতে তৈরি লুঙ্গি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে পাঠান। সেখানকার ব্যবসায়ীরা ঠিক করেই তারপর খুচরা বাজারে বিক্রি করেন। একেক থান (চার পিসে এক থান) লুঙ্গি বিক্রিতে সর্বোচ্চ ১০০ থেকে ১২০ টাকা লাভ করা যায়। অথচ সারা দিনে মাত্র দুই থানের বেশি লুঙ্গি তৈরি করা যায় না। দিন শেষে যা লাভ হয়, তা দিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছেন। শুধু বাপ-দাদার পৈতৃক পেশা ধরে রাখতেই তিনিও এই কাজ করছেন।
গ্রামের আরেক প্রবীণ মোতালেব হোসেন (৬৫) প্রায় ৪০ বছর ধরে লুঙ্গি ও গামছা তৈরির পেশায় যুক্ত আছেন। তিনি বলেন, ‘আগে হাতেচালিত যন্ত্রের সাহায্যে কাপড় বুনতাম। আর এখন তো মেশিন হয়েছে। একেকটি মেশিন বসাতে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লাগে। অনেক কষ্টে দুটি মেশিন বসিয়েছি। আমি নিজে, স্ত্রী আর দুই সন্তান মিলে কাজ করি। প্রতিদিন ভোররাত ৪টা থেকে শুরু করে রাত ১০টা পর্যন্ত চালাই। তারপরও প্রতিদিন চার থানের বেশি লুঙ্গি তৈরি করা যায় না। একেকটি লুঙ্গি প্রায় ২৫০ টাকা হিসেবে এক থান (৪টি) এক হাজার টাকায় বিক্রি করি। প্রতিটি লুঙ্গি থেকে ৩০ থেকে ৪০ টাকার মতো আয় হয়। প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার বেশি আয় করা সম্ভব হয় না। অথচ দুটি মেশিন প্রায় চার লাখ টাকা খরচ করে তিন-চারজন লোক কাজ করি। এরপর সুতাসহ প্রতিটি জিনিসপত্রের দাম বেশি। তাহলে কী থাকে বলুন?’
মোতালেব হোসেন বলেন, আগে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার মতো রোজগার হলেও জিনিসপত্রের দাম কম থাকায় খরচ এত হতো না। সংসারের খরচ শেষে আরও কিছু জমাতে পারতেন। অথচ এখন তাঁর প্রতিদিন সংসারে ৫০০ টাকার ওপর খরচ হয়। মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজন এলে খরচ আরও বেড়ে যায়। তাহলে কীভাবে সামাল দেবেন? এই কাজের পাশাপাশি নিজের দুই বিঘা জমি চাষাবাদ করেন। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে চলতে হচ্ছে।