বিএসএফের গুলিতে নিহত আল আমিনের বাবা সুরুজ আলী বিলাপ করছিলেন। রোববার দুপুরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের জিন্নাতপাড়া এলাকায়
বিএসএফের গুলিতে নিহত আল আমিনের বাবা সুরুজ আলী বিলাপ করছিলেন। রোববার দুপুরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের জিন্নাতপাড়া এলাকায়

পঞ্চগড়ে বিএসএফের গুলিতে নিহত

‘আমার বাপটার লাশটা আইনা দেন, আমি নিজের হাতে গোসল করামু’

‘আল্লাহর দোহাই লাগে আমার বাপটার লাশটা আইনা দেন। আমি কিচ্ছু চাই না, আমি ওরে একটা চুমা দিমু, আর নিজের হাতে গোসল করামু।’ রোববার দুপুরে ঘরের ভেতর বিছানায় বসে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে এভাবেই বিলাপ করছিলেন বিএসএফের গুলিতে নিহত আল আমিনের বাবা সুরুজ আলী (৭০)। এ সময় পাশে বসে থাকা স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

নিহত মো. আল আমিন পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের জিন্নাতপাড়া এলাকার সুরুজ আলীর ছেলে। তিনি সীমান্তে চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানিয়েছে বিজিবি।

রোববার দুপুরে নিহত আল আমিনের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, বাড়িভর্তি স্বজনদের ভিড়। পাশের বাড়ির একটি ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে সন্তান হারানোর শোকে বারবার মূর্ছা যাওয়া মা আয়েশা বেগমকে। ঘরের এক কোণে বিছানায় বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন আল আমিনের স্ত্রী হুমায়রা আক্তার। মায়ের এমন কান্না দেখে কাঁদছিল আল আমিনের ১০ বছর ও চার বছর বয়সী দুই মেয়ে। বাড়ির উঠানে বসে লাশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা।

শুক্রবার গভীর রাতে পঞ্চগড় সদর উপজেলার ভিতরগড় সীমান্তে ৭৪৪ নম্বর মেইন পিলারের ৭ নম্বর সাবপিলার-সংলগ্ন এলাকার ওপারে ভারতের ভাটপাড়ায় কাঁটাতারের বেড়ার লিংক রোডের পাশে বিএসএফের গুলিতে মারা যান মো. আল আমিন (৩৬)। পরে লাশটি ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে বিএসএফ। এ ঘটনায় শনিবার বেলা ১১টার দিকে সীমান্তে বিজিবি-বিএসএফ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক করে ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লাশ ফেরত চেয়েছে বিজিবি। তবে আইনগত প্রক্রিয়া শেষে বিজিবি-বিএসএফের উপস্থিতিতে দুই দেশের পুলিশের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করবে বলে বিজিবিকে জানিয়েছে বিএসএফ।

স্বজন, বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আল আমিন প্রায়ই সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করতেন। তিনি চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত এবং ভারতীয় চোরাকারবারিরা তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। পাঁচ থেকে ছয় দিন আগে আল আমিন ভারতে গিয়েছিলেন বলে জানা গেছে। শুক্রবার দিবাগত রাত তিনটার পর ১০ থেকে ১৫ চোরাকারবারি ভারত থেকে গরু নিয়ে বাংলাদেশের দিকে আসছিলেন। এ সময় ভারতের ৪৬ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের ভাটপাড়া বিএসএফের সদস্যরা তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। এতে আল আমিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ভারতের ভেতরেই মারা যান।

তাঁর লাশ আনার জন্য বিজিবি পরিবারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়েছে।
নিহত আল আমিনের চাচাতো ভাই আবদুল আজিজ বলেন, ভিটেবাড়ি আর অল্প কিছু আবাদি জমি ছাড়া তেমন কিছুই নেই আল আমিনদের। তিন ভাইয়ের মধ্যে আল আমিন সবার ছোট। তাঁর দুই মেয়ে আছে। আল আমিনের বাবা একসময় দিনমজুরের কাজ করলেও এখন বয়সের কারণে কাজ করতে পারেন না। অন্য দুই ভাই দিনমজুরের কাজ করেন। ছেলেরাই মা-বাবাকে দেখভাল করেন। আল আমিন চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর বাবা অনেক কষ্টে তাঁকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে চার বছর থাকার পর প্রায় পাঁচ বছর আগে বাড়িতে ফেরেন তিনি। পরে আবার এসে জড়িয়ে পড়েন চোরাকারবারের সঙ্গে।

কাঁদতে কাঁদতে নিহত আল আমিনের বাবা সুরুজ আলী বলেন, ‘আমার ছেলে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। কয়েক দিন আগে সে আমাকে মাথায় হাত রেখে কথা দিছিল, আর ভারতে ব্ল্যাকি (চোরাকারবারি) করতে যাবে না। এক সপ্তাহ আগে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে আমার বাপ (আল আমিন) একটা গরু কিনেছে দশম রমজানে মিলাদ পড়ানোর জন্য। মিলাদ পড়িয়ে আর কোনো দিন সে বর্ডারে পা দেবে না বলেছিল। এর আগেই আমার বাপটা শেষ হয়ে গেল।’

রোববার বিকেলে নীলফামারী ৫৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ মো. বদরুদ্দোজা প্রথম আলোকে বলেন, নিহত আল আমিনের লাশ ফেরত আনার বিষয়ে বিএসএফের সঙ্গে কথা হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্তসহ অন্যান্য আইনগত প্রক্রিয়া শেষে লাশটি হস্তান্তর করবে বলে বিএসএফ জানিয়েছে।