কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হন বলে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন। সাড়ে চার ঘণ্টা নির্যাতনের পর ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয় বলেও জানান ফুলপরী। তিনি এ বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেত্রীদের নামসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করেছেন। এ ঘটনায় রিট হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠনের পাশাপাশি কিছু নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।
ফুলপরীর প্রতিবাদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো।
প্রথম আলো: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নির্যাতনের ব্যাপারটিকে কীভাবে দেখছেন?
আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, যখন যারা ক্ষমতায় থাকছে, তখন তারা একচেটিয়া দখলদারি ও তাদের মত চাপিয়ে দেওয়ার স্বৈরতান্ত্রিক মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। ফলে আজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে কেউ স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন না। সেটা শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ক্ষমতাসীন দলের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন সবাই। হারিয়ে ফেলছেন বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা-চেতনা। একজন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। সেই শিক্ষার্থীর ওপর যখন নিপীড়ন হয়, তখন মনুষ্যত্ব বলে কিছু থাকে না।
প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কেন বারবার একই ঘটনা ঘটছে?
আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি সর্বজনীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সেখানে ছাত্র-শিক্ষক সবারই সমান মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শেখার জায়গা বিশ্ববিদ্যালয়। শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার মূল কেন্দ্র এটি। কিন্তু রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রভাব আমাদের সেই জায়গা থেকে বিচ্যুতি ঘটাচ্ছে।
প্রথম আলো: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রীর প্রতিবাদকে কীভাবে দেখছেন?
আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। তাঁরা অনেক সময় এ ধরনের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রভাব থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী এমন প্রতিবাদ করেছেন, তাঁকে আমি সাধুবাদ জানাই। আমি মনে করি, এ ধরনের প্রতিবাদ সব ক্ষেত্রে, সব জায়গায় করা উচিত। ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে এ ধরনের প্রতিবাদে সহযোগিতা করা উচিত। তাঁদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
প্রথম আলো: ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নির্যাতন থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে কী করা উচিত?
আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: প্রথম বর্ষের কোনো শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে আসেন অনেক স্বপ্ন নিয়ে। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই যদি তাঁকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়, তাহলে ওই শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে, সেটি সহজেই অনুমেয়। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দ দেখভালের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে একজন শিক্ষার্থীর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথম আলো: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কী হতে পারে?
আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী: একসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যে সর্বজনীন উন্নয়নের ধারা ছিল, বর্তমানে সেটি অনেকটাই নেই। এর অন্যতম কারণ একনায়কতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা। সব সময় আমি যা বলব, সেটিই শুনতে হবে এমন মানসিকতা। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে এ ধরনের চিন্তাভাবনা দেখা যাবে। সরকার বা প্রশাসনের শীর্ষে যাঁরা থাকেন, তাঁরা মনে করেন, তিনি যা বলছেন, সেটি ন্যায়-অন্যায় যা–ই হোক, সবাইকে পালন করতে হবে। এ জায়গা থেকে যদি আমরা সরে না আসি, তাহলে একসময় আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অস্তিত্ব, মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তায় পচন ধরবে। সেই পচনে পুরো সমাজ নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে হলে অবশ্যই আমাদের এ ধরনের কার্যক্রম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।