দুধের ছানায় তৈরি হয় নানা রকমের সন্দেশ। এমন এক সন্দেশের নাম ‘ওহাবের সন্দেশ’। স্বাদে অতুলনীয় এই সন্দেশ মিলবে নড়াইল সদর উপজেলার ছোট নদী চিত্রার পাশে গোবরা বাজারে চাকচিক্যহীন ছোট্ট এক দোকানে। ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে জনপ্রিয় গোবরা বাজারের ওহাবের সন্দেশ।
এই মিষ্টির কারিগর ছিলেন আবদুল ওহাব মোল্যা। তিনি মারা গেছেন। বাবার হাতের তৈরি সেই সন্দেশের স্বাদ এখনো ধরে রেখেছেন তাঁর বড় ছেলে মহব্বত মোল্যা।
নড়াইল সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়নের গোবরা বাজার। নড়াইল শহর থেকে নড়াইল-ফুলতলা সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিকে সাত কিলোমিটার পথ গেলেই দেখা মেলে চিত্রা নদীর। উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া চিত্রা নদী গোবরা বাজার এলাকায় বাঁক দিয়ে পূর্বমুখী হয়েছে। সেখান থেকে নদীর একটি ধারা কাজলা নদী নাম ধারণ করে পশ্চিমমুখী হয়েছে। নদীর দুই তীরে গোবরা বাজার। বাজারের মধ্যে চিত্রা নদীর তীরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি হিজলগাছ। এই ‘শতবর্ষী হিজল’ গাছের নিচে ওহাবের সন্দেশের দোকান।
ওহাব মোল্যা মারা যান বছর চারেক আগে। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে মহব্বত মোল্যা আর ছোট ছেলে হাসিব মোল্যা যৌথভাবে সন্দেশ তৈরি করেন। সম্প্রতি দোকানে গিয়ে দেখা গেল, চারদিকে টিনের বেড়া ও ওপরে টিনের চাল দিয়ে বানানো পুরোনো একটি দোকান। সামনের কাচের তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে থরে থরে সন্দেশ। সঙ্গে অন্য মিষ্টিও আছে। ঘরের ভেতর কাঠের তৈরি চারটি টেবিল ও কিছু চেয়ার পাতা। তাতে বসে সন্দেশ খাচ্ছেন মিষ্টিপ্রেমীরা। দোকানের পেছনে আছে সন্দেশ ও দই তৈরির ছোট্ট একটি কারখানা।
সন্দেশ কীভাবে বানান, জানতে চাইলে দুই ভাই মহব্বত মোল্যা ও হাসিব মোল্যা বলেন, কড়াইতে ভালো করে জ্বাল দিয়ে প্রথমে দুধের ছানা তৈরি করা হয়। ছানা তৈরির জন্য আগের দিনের রাখা ছানার পানি নির্দিষ্ট পরিমাণে জাল দেওয়া দুধের সঙ্গে মেশাতে হয়। ছানা হলে তা একটি কাপড়ে বেঁধে পানি ঝরানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়। পানি ঝরা শেষ হলে সেই ছানার সঙ্গে চিনি মিশিয়ে কড়াইতে অল্প জ্বাল দিয়ে সন্দেশ তৈরি করা হয়।
এখানে সন্দেশ খেতে আসা উপজেলার খলিশাখালী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস (৬১) বলেন, ‘আমি কোনো কাজে এ দিকে এলেই এই দোকানে আসি সন্দেশ খেতে। এ সন্দেশের কোনো তুলনা নেই। এই সন্দেশ নির্ভেজাল। অনেক জায়গায় সন্দেশ খেয়েছি, কিন্তু এই স্বাদ আর কোথাও পাইনি।’
দুই ভাই জানালেন, আগে দোকানে বসে যাঁরা সন্দেশ খেতেন, তাঁদের পাশের বিল থেকে সংগ্রহ করা পদ্মপাতায় সন্দেশ দেওয়া হতো। এখন আর বিলে পদ্মপাতা পাওয়া যায় না। এ জন্য প্লেটে করে সন্দেশ দেওয়া হয়। সন্দেশের পাশাপাশি দোকানে দই বিক্রি করা হয়। আছে গরুর দুধের চা। প্রতিদিন গড়ে ২০ কেজি দুধের সন্দেশ, ২০ কেজি দুধের দই এবং ১০ কেজি দুধের চা তৈরি করা হয়।
পদ্মপাতায় সন্দেশ খাওয়ার কথা স্মরণ করলেন ২৫ বছর ধরে ওহাবের সন্দেশ খেতে আসা উপজেলার খলিশাখালী গ্রামের শিক্ষক মুজয় কুমার বিশ্বাস (৫৭)। তিনি বলেন, ওহাব মোল্যার সন্দেশ ও দই অতুলনীয়। আগে পদ্মপাতায় সন্দেশ দেওয়া হতো। এখন প্লেটে করে দেওয়া হয়।
মহব্বত মোল্যা সন্দেশ বানানো প্রসঙ্গে বলেন, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে তিনি দোকানে আসতেন। তখন দেখেছেন, কীভাবে সন্দেশ বানাতে হয়। সেই থেকে ৪৩ বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন। ২০ কেজি দুধ জ্বাল দিয়ে ছানা পাওয়া যায় আড়াই থেকে তিন কেজি। এর সঙ্গে কেজিখানেক চিনি মেশানো হয়। সন্দেশ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আর দই ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়।
নড়াইল ও আশপাশের এলাকার লোকজন এখানে সন্দেশ খেতে যান। দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে কেউ এলে তাঁরা এই দোকানের দই ও সন্দেশ নিয়ে যান।