অনেকে বলেন, গাইবান্ধা রসমঞ্জুরির জন্য পরিচিত। সুস্বাদু এই মিষ্টির সুনাম দেশব্যাপী। মন ভরে রসমঞ্জুরি খাওয়ার পাশাপাশি চোখ ভরে প্রকৃতি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে এই শীতে ভ্রমণে যেতে পারেন গাইবান্ধায়। জেলার গোবিন্দগঞ্জে আছে বিরাট রাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, সদরে শাহ সুলতান গাজীর ঐতিহাসিক মসজিদ, ফুলছড়িতে আছে মাটির নিচে ঘর ও ঘোরাফেরার জন্য বালাসি ঘাট, আছে দৃষ্টিনন্দন পৌর পার্ক ও ঘাঘট লেক।
গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে গাইবান্ধা-বালাসি সড়ক ঘেঁষে মাটির নিচে ঘর। নাম ফ্রেন্ডশিপ সেন্টার। মাটির নিচে সব দাপ্তরিক কার্যালয়। ফুলছড়ি উপজেলার মদনের পাড়া গ্রামে অবস্থিত সেন্টারে আছে প্রশিক্ষণকেন্দ্র ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। ওপরে প্রকৃতিঘেরা পরিবেশ। ২০১২ সালের ১৮ নভেম্বর প্রায় আট বিঘা জমির ওপর এটি গড়ে ওঠে। ভবনের ছাদ সমতল ভূমির সমান। ছাদে লাগানো হয়েছে নানা জাতের ঘাস। ভবনটি স্থানীয়ভাবে তৈরি ইটের গাঁথুনিতে বানানো। সুন্দর স্থাপত্যের জন্য ফ্রেন্ডশিপ সেন্টারটি ২০১২ সালে লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্কিটেক্ট রিভিউ এআরপ্লাসডি অ্যাওয়ার্ড এবং পরে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়।
শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রাজাহার ইউনিয়নে অবস্থিত বিরাট রাজার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জায়গা। বিরাট রাজার বড় বড় পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। গাইবান্ধার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এটি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লিখে রেখে গেছেন।
কথিত আছে, একসময় এ জায়গায় বড় আকারের মাটি ও ইটের প্রাচীরবেষ্টিত বিরাট রাজার বসতি ছিল। এখান থেকে ব্রোঞ্জ ও পাথরের প্রতিমা, পোড়ামাটির চিত্রফলক, মৃৎপাত্র ও ধাতবপাত্রের টুকরা পাওয়া গিয়েছিল। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বেশির ভাগই ধ্বংস হয়ে গেছে। সংরক্ষিত হিসেবে বর্তমানে তিনটি ঢিবি টিকে আছে। এগুলো দেখতে মানুষ এখানে ভিড় করেন।
এ ছাড়া সাদুল্যাপুর উপজেলার নলডাঙ্গা এলাকায় অবস্থিত নলডাঙ্গা জমিদারবাড়িও ঘুরে দেখার মতো।
সদর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে দাড়িয়াপুরে অবস্থিত মীরের বাগান নামে পরিচিত ঐতিহাসিক শাহ সুলতান গাজীর মসজিদ। এটি ১০১১ সালের। মীরের বাগানের সঙ্গে ইতিহাসখ্যাত মীর জুমলার সম্পর্ক আছে বলে প্রচলিত আছে। অতীতে বিশাল এক আমবাগানের জন্য এই মীরের বাগান প্রসিদ্ধ ছিল।
ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখ ঘাট ও জামালপুরের বাহাদুরাবাদে নৌপথ চালু করে। তখন থেকে এ পথের মাধ্যমে ঢাকা-দিনাজপুর রেল যোগাযোগ চালু ছিল। উত্তরাঞ্চলের আটটি জেলার মানুষ ট্রেনে তিস্তামুখ ঘাটে যেতেন। এরপর তিস্তামুখ ঘাট-বাহাদুরাবাদ রুটে ফেরি পারাপার হতেন। ওপারে বাহাদুরাবাদে গিয়ে ট্রেনে উঠে ঢাকায় যেতেন। ১৯৯০ সালে নদীর নাব্য–সংকটের কারণে তিস্তামুখ ঘাটটি একই উপজেলার বালাসিতে স্থানান্তর করা হয়। তখন বালাসি-বাহাদুরাবাদ রুটের মাধ্যমে একইভাবে রেল যোগাযোগব্যবস্থা চালু ছিল। তৎকালীন বালাসি ঘাটে রেলওয়ের অন্তত ৩০টি নানা ধরনের নৌযান ছিল। ২০১৫ সালের পর এসব নৌযান বিক্রি করা হয়।
এদিকে নদীতে নাব্যতা হ্রাসের কারণে বালাসি-বাহাদুরাবাদ পথে রেলওয়ের ফেরি চলাচল বন্ধের উপক্রম হয়। ১৯৯৮ সালের জুন মাসে যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হয়। ফলে ২০০০ সাল থেকে এ রুটে রেলের ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অকার্যকর হয়ে পড়ে বালাসি ঘাট। তবে এই বালাসি ঘাটে এখন অনেকে ঘুরতে যান মুক্ত বাতাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে।
গাইবান্ধা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত পৌর পার্ক দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর থাকে। শহরের ব্যস্ততম ডিবি রোড ঘেঁষে এই পার্ক। পার্কের ভেতরে বিশাল ঘাটবাঁধা পুকুর। পুকুরে চলছে ডিঙি নৌকা। পুকুরের চারদিকে পাকা রাস্তা। রাস্তা ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে হাতি, ঘোড়া, হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখির প্রতিকৃতি। এসব সাজানো হয়েছে লাল-নীল বাতি দিয়ে। পৌর পার্কে শোভা পাচ্ছে চরকি, নাগরদোলা, দোলনা। বিকেল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত পার্কটি জমজমাট থাকছে।
গাইবান্ধা শহরের ঘাঘট লেক একসময় ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি ছিল। পোকামাকড় ও কচুরিপানার কারণে ভয়ে কেউ লেকে নামতে পারত না। সংস্কারের পর সেটি এখন বিনোদন পার্ক হয়ে উঠছে। ইতিমধ্যে লেকের ওপর নির্মাণ করা দৃষ্টিনন্দন দুটি সেতু। পাকা সিঁড়ি, চলাচলের রাস্তা ও দুই পাশে বসার বেঞ্চ তৈরি করে লেকের সৌন্দর্য বাড়ানো হয়েছে।
এ ছাড়া শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে পলাশবাড়ী উপজেলা সদরে ড্রিমল্যান্ড পার্ক, প্রায় ২৯ কিলোমিটার দূরে সাঘাটা উপজেলার সাহেব বাজারে ড্রিম সিটি পার্ক, প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর আলিবাবা থিম পার্ক এবং ৩৮ কিলোমিটার দূরে একই উপজেলার সোনারায় এলাকায় সরোবর পার্ক আছে। এগুলোতে বেড়াতে যেতে পারেন যে কেউ।