কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের জুয়ান সতরার চরে বাস ছিল নুরনাহার বেগমের (৬০)। তিস্তার ভাঙনের কবলে পড়ে পাঁচ মাস আগে চলে আসেন পশ্চিম জুয়ান সতরার চরে। এখানে এসে দফায় দফায় বন্যার কবলে পড়ছেন নুরনাহার।
আজ রোববার সকালে মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘চার দিন থাকি ঝরি (বৃষ্টি) আর ঝরি। কাজকাম বন্ধ। এর মধ্যে হু হু করি তিস্তার পানি আসি ঘরত ঢুকিল। গরু-ছাগল পাশের বাড়ির উঁচা জায়গাত থুয়ে হামরা বিছানা উঁচা করি কোনোমতে আছি। বানের পানিত রান্নাঘর, চুলা ডুবি গেইছে, এল্যা রান্না করি ক্যামন করি আর কী খায়া থাকি।’
কয়েক দিন থেকে ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের প্রায় সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে। তিস্তা নদীর পানি তিন দিন থেকে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নুরনাহার বেগমের বাড়িতে পানি উঠেছে। এটি কুড়িগ্রামের তিস্তা চরের বাসিন্দাদের জন্য এ বছরের চতুর্থ বন্যা। এর ১০ দিন আগেও এখানে পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তখন নুরনাহার বেগমের দুটি ছাগল মারা গেছে। এবারে তিনি আর ঝুঁকি নেননি। বন্যা শুরুর আগেই প্রতিবেশীর উঁচু ভিটায় গরু-ছাগল পাঠিয়ে দিয়েছেন।
নুরনাহার বেগম বলেন, ‘সবাই ড্রেজার দিয়ে ভিটেবাড়ি উঁচা করছে। আমরা গরিব মানুষ। নিজেরা হালকা একটু মাটি তুলেছিলাম। বুঝবার পারি নাই, এত পানি হবে। দিনের বেলায় তো থাকা যায়, রাত হলেই পোকামাকড়ের (সাপ) খুব ভয়।’
একই অবস্থা জুয়ান সতরা গ্রামের হালিমুর রশীদের। তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করলে তিনি ছোট ছেলেমেয়ে ও বর্গা নেওয়া দুটি ছাগল নিয়ে পাশে শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তিস্তা নদীতীরবর্তী জুয়ান সতরা চরে প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের বাস। তাদের কারও বাড়িতে পানি উঠেছে, আবার কেউ পানিবন্দী হয়ে আছে। তাদের কেউ ত্রাণ পায়নি।
জুয়ান সতরা চরের বাসিন্দা ও সাবেক ইউপি সদস্য আবুল কাশেম বলেন, ‘চরের মানুষের দুঃখের শেষ নাই গো ভাই। নদীভাঙন, বন্যায় খুব কষ্ট। কিন্তু কেউ পাশে থাকে না। শুধু ভোটের সময় চরের মানুষের দাম হয়, এ ছাড়া চরের মানুষকে কাঈও হিসাবে রাখে না। আজ তিন দিন থাকি বৃষ্টি আর বানের পানিতে ঘরে রান্না বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো কোনো ত্রাণ পেলাম না।’
উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়ন জুয়ান সতরার চর থেকে নদীপথে বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের দূরত্ব এক ঘণ্টার কম সময়। গতকাল বিকেলে জুয়ান সতরার চর থেকে কিছুদূর যেতেই চর গোড়াইপিয়া, আনন্দবাজার, চর বিদ্যানন্দ গ্রামে ফসল পানিতে ডুবে থাকার দৃশ্য দেখা গেল। ডুবে যাওয়া জমির ধানখেতে জমা হওয়া কচুরিপানা ভাটিতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন আবদুল রব নামের এক কৃষক। তিনি বলেন, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও তিস্তার পানি বেড়ে রোপা আমন ধান তলিয়ে গেছে। এর আগের বন্যার সময় তিস্তার ঢলে বালু পড়ে দুই বিঘা জমির ধানখেত তলিয়ে গেছে। এবারের বন্যার তিস্তার চর বিদ্যানন্দ, আনন্দবাজারসহ বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চরাঞ্চলের প্রায় ২০০ একরের বেশি ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। বানের পানি বেশি দিন স্থায়ী হলে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হবে বলেও তিনি জানান।
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত প্রথম আলোকে বলেন, উজানের ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে কুড়িগ্রামের নদ-নদীর পানি বেড়ে জেলার প্রায় ৭০৫ হেক্টর রোপা আমন ধান তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া ৮ হেক্টর রোপা আমন বীজতলা, ১১০ হেক্টর সবজিখেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বন্যা দীর্ঘমেয়াদি না হলে রোপা আমনের তেমন ক্ষতি হবে না। তবে সবজিখেতের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
উজানের ঢল ও তিস্তার প্রবল স্রোতে রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের বুড়িরহাটে তিস্তা স্পার বাঁধের প্রায় ৩০ মিটার এলাকায় আরসিসি অংশে ধস দেখা দিয়েছে। গতকাল শনিবার রাত আনুমানিক ৯টার সময় তিস্তার প্রবল স্রোতে ওই স্পার বাঁধে ধস দেখা দেয়। এতে তিস্তা স্পার বাঁধের ভাটিতে থাকা কয়েক শ পরিবার নদীভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে।
ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মামুনুর রশিদ জানান, তিস্তার প্রবল স্রোতে স্পার বাঁধটির আরসিসি অংশে ধস দেখা দিয়েছে। এই স্পার বাঁধটি রক্ষা করতে না পারলে বাঁধের ভাটিতে থাকা বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের শত শত পরিবার নিমেষেই নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। গতকাল বাঁধে ধস দেখা দিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে এলাকাবাসী যৌথভাবে কাজ করেছে।
বাঁধের ভাটিতে বসবাসকারী স্থানীয় বাসিন্দা খাইরুল আলম বলেন, ‘এই স্পার বাঁধ না থাকলে বিদ্যানন্দ ইউনিয়ন এত দিনে তিস্তার পেটে নাই হয়ে যেত। গতকাল সকাল থেকে স্পার বাঁধে ধস দেখা দেয়। সারা দিন পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলাকাবাসী বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেছে। শেষ রক্ষা হলো না, রাত ৯টার দিকে বাঁধের একাংশ ধসে গেছে। এই বাঁধ ছুটে গেলে কয়েক হাজার বসতবাড়ি ভাঙনের মুখে পড়বে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল্লাহ আল মামুন গতকাল বিকেলে জানান, ভারী বৃষ্টি ও প্রবল স্রোতে তিস্তা স্পার বাঁধ এলাকায় কিছু অংশে ধস দেখা দিয়েছে। সেখানে পাউবোর কর্মীরা জিও ব্যাগ ফেলছেন।
বৃষ্টি কিছুটা কমে এলেও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের অন্যান্য নদ-নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও এসব নদ-নদী অববাহিকায় গোচারণভূমি বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ বালাডোবা গ্রামের ২০টি পরিবার পানিতে তলিয়ে গেছে।
আজ সকাল ৯টায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুড়িগ্রামের তথ্যমতে, তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৪০ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদী নুনখাওয়া পয়েন্টে ৫৭ সেন্টিমিটার, ধরলা নদীর পানি সদর পয়েন্টে ৬৩ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদ পাটেশ্বরী পয়েন্টে ৩০ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিনের ভারী বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানি বেড়ে রাজারহাট উপজেলার দুটি ইউনিয়ন এবং উলিপুরের একটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। জেলায় ৩৬২ মেট্রিক টন চাল, ৫ লাখ টাকা ও ৩ হাজার ৭০০ প্যাকেট শুকনা খাবার, শিশুখাদ্য বাবদ ২ লাখ ও গোখাদ্য ক্রয় বাবদ ৫ লাখ টাকা নগদ মজুত আছে। নদীভাঙন রোধে তাৎক্ষণিক জিও ব্যাগ ফেলার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দেওয়া আছে।