ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনের উপনির্বাচনের বাকি আর দুই দিন। এ নির্বাচনে বিএনপির দলছুট নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদকে গত শুক্রবার থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকার কোথাও প্রচারণায় দেখা যায়নি। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, গত শুক্রবার রাত থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তাঁরা। তিনি নিখোঁজ রয়েছেন।
আবু আসিফ আহমেদ আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। তিনি উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়ার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। আবু আসিফের ‘নিখোঁজ’ হওয়ায় নির্বাচনে সাত্তারের জয়ের পথ আরও সহজ হলো বলে মনে করছেন স্থানীয় রাজনীতিকেরা।
এর আগেই নির্বাচন থেকে আবু আসিফকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। তখন আবু আসিফ অভিযোগ করেছিলেন, তাঁর নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মী-সমর্থকদেরও নানাভাবে হয়রানি করাসহ ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। তবে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন না।
‘শুক্রবার বাসায় ছিলাম না। দুপুরে মুঠোফোনে স্বামীর সঙ্গে কথা হয়। এরপর যতবারই ফোন করেছি, তিনি ফোন ধরেননি। তবে ফোন বেজেছিল। এ ছাড়া অনেককেই ফোন করে স্বামীর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি।মেহেরুননিছা, আবু আসিফের স্ত্রী
গত বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে ‘নিখোঁজ’ হন তাঁর নির্বাচন পরিচালনার প্রধান সমন্বয়কারী ও তাঁর শ্যালক শাফায়াত সুমন (৩৮)। তিনি আশুগঞ্জের লালপুর গ্রামের বাসিন্দা। এ ছাড়া আবু আসিফের নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্বে থাকা মুসা মিয়াকে ওই দিন দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ১৩ জানুয়ারি আশুগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলার একটি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
আবু আসিফের ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) সোহাগ মিয়া ও ভাতিজা মো. আমিনও গত শুক্রবার মুঠোফোন বন্ধ করে এলাকা ছেড়েছেন বলে জানা গেছে। তাঁরা কেউ আবু আসিফের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না।
গতকাল রোববার বেলা আড়াইটার দিকে আশুগঞ্জ উপজেলার বাজার এলাকায় আবু আসিফের বাড়িতে গিয়ে প্রধান ফটকে তালা ঝুলতে দেখা যায়। বাড়ির পেছনের ছোট ফটকে দারোয়ান ইছু মিয়াসহ তিনজন বসে ছিলেন। পরিচয় দিলে তাঁরা ফটক খুলে দেন।
আবু আসিফের স্ত্রী মেহেরুননিছা প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুক্রবার বাসায় ছিলাম না। দুপুরে মুঠোফোনে স্বামীর সঙ্গে কথা হয়। এরপর যতবারই ফোন করেছি, তিনি ফোন ধরেননি। তবে ফোন বেজেছিল। এ ছাড়া অনেককেই ফোন করে স্বামীর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি।
‘তিন দিন ধরে একজন প্রার্থী নিখোঁজ। তিন দিন পর প্রার্থীর স্ত্রীর গণমাধ্যমকে বললেন, তাঁর স্বামী নিখোঁজ। কিন্তু আমাদের কাছে বলেনি ও অভিযোগও করেনি। মৌখিকভাবেও জানায়নি।’মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন, পুলিশ সুপার
তাঁরা কেউই কিছু জানেন না।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার বাসার আশপাশে দুই-চারজন করে লোক ঘোরাফেরা করে মানুষের ছবি তুলছেন। নির্বাচনের কর্মীরা ভয়ে কেউই আমার সঙ্গে দেখা করতে পারছে না। এমনকি কাজের লোকজনও বাসায় আসতে পারছেন না। যাঁরাই আসছেন, তাঁদের ছবি তোলা হচ্ছে। কেউ বাসায় আসতে চাইছে না। শনিবার রাতে বেশ সময় ধরে আমার বাসা তল্লাশি করেছে পুলিশ।’
দারোয়ান ইছু মিয়াও প্রায় একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘শুক্রবার দুপুর দুইটায় স্যার (আবু আসিফ) বাসায় আসে। আমি তখন একজনের কাছে চাবি দিয়ে নিজ বাড়িতে চলে যাই। এরপর আর স্যারেক দেখিনি। শুক্রবার রাতে পুলিশ এসে আমার ছবি তুলে এবং বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করে। সিসি ক্যামেরাও চেক করে দেখে। দুজন, চারজন, পাঁচজন করে এসে আমাকে চাপ দিচ্ছেন। স্যার কোথায় আছেন জানতে চান।’
কীভাবে নির্বাচনের কাজ করবেন বুঝতে পারছেন না উল্লেখ করে মেহেরুননিছা বলেন, ‘তাঁকে (আবু আসিফ) যেহেতু পাচ্ছি না, তিনি সিদ্ধান্ত না দিলে তো নির্বাচন ছাড়তে পারব না। তবে কর্মীরা নির্বাচন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন।’
‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।’অরবিন্দ বিশ্বাস, ইউএনও ও উপনির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা
মেহেরুননিছা বলেন, ‘কারা এজেন্ট হবে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে। আমাদের যদি এভাবে চাপিয়ে রাখে আমরা কোথায় দাঁড়াব? আমাদের আশ্রয়টা কোথায়? ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে আছি। আমাকে নজরবন্দী করে রাখা হয়েছে।’ তিনি বলেন, আবু আসিফের নিখোঁজের বিষয়টি আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে।
আশুগঞ্জ উপজেলার কয়েকজন বাসিন্দা ও আবু আসিফের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নাম না প্রকাশ করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, আবু আসিফকে ভয় দেখানো হয়েছে। তাঁকে মেরে লাশ মেঘনায় ফেলা দেওয়া হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। সেই ভয়ে হয়তো ‘আত্মগোপনে’ রয়েছেন।
ইউএনও ও উপনির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা অরবিন্দ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।’
জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন দিন ধরে একজন প্রার্থী নিখোঁজ। তিন দিন পর প্রার্থীর স্ত্রীর গণমাধ্যমকে বললেন, তাঁর স্বামী নিখোঁজ। কিন্তু আমাদের কাছে বলেনি ও অভিযোগও করেনি। মৌখিকভাবেও জানায়নি।’ আবু আসিফের বাড়ির আশপাশে পুলিশের কোনো সদস্য ঘোরাফেরা করেননি এবং বাসায় তল্লাশি করতে যাননি বলে দাবি করেন তিনি।
আলোচিত এই উপনির্বাচনে অংশ নিতে ১৩ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর পাঁচজনের মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করা হয়। আট প্রার্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের তিন নেতা দলীয় সিদ্ধান্তে তাঁদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। পরে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা।
উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া ও আবু আসিফ আহমেদ ছাড়া নির্বাচনে আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাপার কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব আবদুল হামিদ ভাসানী ও জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম।