যশোর জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ১১ গুণ রোগী

এই হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের (নারী) ১৪ রোগীর বিপরীতে গতকাল ১৪৯ রোগী ভর্তি ছিলেন। এতে ওই ওয়ার্ডে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে।

যশোর জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের (নারী) বারান্দা ও সিঁড়িতে শয্যা পেতে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়
 ছবি: প্রথম আলো

যশোর জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে (নারী) ১৪টি শয্যা রয়েছে। কিন্তু এখানে ১৪৯ রোগী ভর্তি রয়েছেন। দুই শয্যার মাঝের খালি জায়গা, চলাচলের বারান্দা, এমনকি সিঁড়িতে শয্যা পেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কোথাও পা ফেলার জায়গা পর্যন্ত নেই। ওয়ার্ডজুড়ে অতিরিক্ত রোগী ও তাঁদের স্বজনদের উপস্থিতিতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে।

শুধু মেডিসিন ওয়ার্ডেই নয়, এই হাসপাতালের অধিকাংশ ওয়ার্ডেই শয্যার চেয়ে অনেক বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন। গতকাল রোববার ২৭৮ শয্যার এই হাসপাতালে ৬২৫ রোগী ভর্তি ছিলেন। শয্যার চেয়ে বেশি রোগী ভর্তি হওয়ায় চিকিৎসক ও নার্সরা চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। এদিকে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতালের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া আয়া, ওয়ার্ড বয় ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নাকে অক্সিজেনের পাইপ লাগানোসহ নানা সেবা দেওয়ার নামে ১০০–২০০ টাকা বকশিশ নিচ্ছেন। এ ছাড়া নিয়মিত পরিষ্কার না করায় শয্যাগুলোয় তেলাপোকা বেড়ে গেছে। তেলাপোকার উৎপাতে রোগীরা অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।

গত শনিবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, ওয়ার্ডের (প্রবেশমুখে সিঁড়ির পাশে বারান্দায় ১৫০ বর্গফুটের মতো একটি জায়গায় বিছানো ফেলে চার রোগীকে রাখা হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন অন্তত ১২ স্বজন। তাঁদের কেউ বিছানায় বসে পান খাচ্ছেন, কেউ ভাত খাচ্ছেন। ওয়ার্ডের ভেতর প্রবেশ করে রীতিমতো বিস্মিত হতে হলো। ওয়ার্ডের ভেতর নার্সদের টেবিলের সামনে রোগীর স্বজনদের জটলা। অন্তত ২০ জন সেখানে দাঁড়িয়ে তাঁদের রোগীদের বিষয়ে নার্সদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। দুই শয্যার মাঝের খালি জায়গা, মেঝে, চলাচলের জায়গা—সবখানেই শয্যা বিছিয়ে রাখা হয়েছে। প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে চার থেকে নয়জন আত্মীয় রয়েছেন।

এই ওয়ার্ডে চার নার্স রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার দায়িত্বে রয়েছেন। ৪ নার্সের পক্ষে ১৪৯ রোগীর সেবা দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ওই সুযোগ নিয়েছেন হাসপাতালের অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া আয়া, ওয়ার্ড বয় ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। তাঁরা রোগীর নাকে পাইপ লাগানোর জন্য ২০০ ও রোগীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্যাথলজিতে নিতে সাহায্য করার জন্য প্রতিবার ১০০ টাকা বকশিশ নিচ্ছেন।

অসুস্থ মাকে নিয়ে এখানে এসেছেন যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার আদমপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহ আলম। তিনি বলেন, ‘আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লে শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের নারী ওয়ার্ডে কোনো শয্যা খালি নেই। সিঁড়ির পাশে বারান্দায় বিছানা ফেলে রাখা হয়েছে। চিকিৎসক নাকে পাইপ লাগানোর পরামর্শ দিলে ওষুধের দোকান থেকে কিনে এনে দিই। ওই পাইপ লাগিয়ে দিতে বললে নার্সরা না এসে প্রশিক্ষণ না থাকা একজন আয়াকে পাঠিয়ে দেন। ওই আয়া মায়ের নাকে পাইপ লাগিয়ে দিয়ে ২০০ টাকা বকশিশ দাবি করেন। কথা–কাটাকাটির এক পর্যায়ে ভদ্রতার খাতিরে ২০০ টাকা দিয়ে দিই।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই ওয়ার্ডে কর্মরত এক নার্স বলেন, ‘৪ জন নার্স দিয়ে ১৪ জনের সেবা দেওয়া যায়। কিন্তু ১৪৯ জনের সেবা দেওয়া যায় না। আমরা কয়জন রোগীর কাছে যেতে পারি। বাধ্য হয়েই আয়া পাঠিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। তবে ওই আয়া টাকা নিয়েছেন কি না, তা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’

বকশিশ নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ বলেন, ‘বকশিশ নেওয়ার বিষয়টি আমাদের জন্যও অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কিন্তু এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। এর কারণ হলো ২৭৮ শয্যার এই হাসপাতালে আজ রোববার (গতকাল) ৬২৫ জন রোগী ভর্তি। বহির্বিভাগের ১৬টি বিভাগে আড়াই হাজারের বেশি রোগীকে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ২৫০ শয্যার জন্য এই হাসপাতালে জনবলকাঠামো রয়েছে। ওই অনুযায়ী সব পদেও জনবল নেই। যে কারণে ১০৫ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যেহেতু তাঁরা বেতন পান না, সেহেতু বকশিশ নেওয়ার বিষয়টা জেনেও আমরা জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারছি না।’

মেডিসিন ওয়ার্ডের (নারী) কয়েকটি শয্যার তোশক উঁচু করে দেখা গেল, সেখানে শত শত তেলাপোকা ঘোরাঘুরি করছে। রাতে ওই তেলাপোকা বেরিয়ে এসে উৎপাত করে। শৌচাগারে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ, যা ব্যবহারের একেবারেই অনুপোযোগী। সিঁড়ির কোনায় কোনায় পানের পিকের দাগ রয়েছে। এখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে।

এসব বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তেলাপোকা মারার জন্য বিষ প্রয়োগ করতে হবে। কিন্তু হাসপাতালের শয্যা কখনো খালি হয় না। একজন রোগী নেমে যাওয়ার আগেই আরেকজন উঠে পড়েন। এত বেশি রোগীর চাপ যে এ জন্য কিছু করা যাচ্ছে না।’

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ৩৬টি সুইপার পদের অনুকূলে রয়েছেন ২৭ জন। অথচ হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কমপক্ষে ৭২ জন সুইপার প্রয়োজন। এ ছাড়া আয়া, ওয়ার্ডসহ অন্যান্য পদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।’

দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ‘চিকিৎসক রাউন্ডে যাওয়ার সময়ই কেবল দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ ছাড়া সারা দিনে নিয়ন্ত্রণের আর কোনো ব্যবস্থা নেই।’

ডেঙ্গু ওয়ার্ডে শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে

এই হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ২৮ রোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচ শিশু রয়েছে। গত ছয় দিনে শিশু আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শনিবার দুপুর ১২টা থেকে গতকাল দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চারজন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে মোট ২৮ জন ভর্তি আছেন। এর মধ্যে পাঁচটি শিশু রয়েছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যশোরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে থাকলেও শিশুদেরআক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত একজন শিশুও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ছিল না। কিন্তু চলতি আগস্ট মাসের শুরু থেকেই শিশু আক্রান্ত বাড়ছে। এটা আমাদের জন্য সতর্ক হওয়ার বিষয়।’