শাকবাড়িয়া নদীর তীরে পারুল রানীর বসতঘর। ঘূর্ণিঝড় দানার আঘাতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে তাঁকে। আজ দুপুরে খুলনার কয়রা উপজেলার পাথরখালী গ্রামে
শাকবাড়িয়া নদীর তীরে পারুল রানীর বসতঘর। ঘূর্ণিঝড় দানার আঘাতে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে তাঁকে। আজ দুপুরে খুলনার কয়রা উপজেলার পাথরখালী গ্রামে

সুন্দরবন উপকূলে ‘দানা’ আতঙ্ক: ‘এবার ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ ভাঙলি এলাকা ছাড়তি হবেনে’

‘শুনতিছি দানা নামের এক ঝড় আসটিছে আমাগের দিকে। প্রতিবার ঘূর্ণিঝড় হলি অন্য কোথাও বেড়িবাঁধ না ভাঙলিও আমাগের কপোতাক্ষ পাড়ের বাঁধ ভাঙবেই। ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ এখনো মেরামত শেষ হয়নি। আবার ঝড় আসলি আর নদীর পানি বাড়লে বেড়িবাঁধ রক্ষা হবে না। তখন ঘরবাড়ি, চিংড়িঘের, খেত–ফসল সব নোনাপানিতে ভেসে যাবে। এবার বেড়িবাঁধ ভাঙলি আমাগে এলাকা ছাড়তি হবেনে।’

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’-এর আগাম সতর্কসংকেত শুনে নিজের আশঙ্কার কথা বলছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার দশালিয়া গ্রামের মজিবর গাজী। গত চার বছরের মধ্যে তিনবার ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ ভাঙনের পাশাপাশি তাঁর বসতঘরও ভেঙেছিল। এসব পরিস্থিতি সামাল দিয়ে নতুন ঘর তুলে এখন বাঁধের পাশে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। আবারও ঝড়ের সংকেত শুনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।

ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে জোয়ারের পানি বাড়লে বেড়িবাঁধ উপচে কিংবা ভেঙে কপোতাক্ষ নদের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারে। আজ বুধবার দুপুরে খুলনার কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ লঞ্চঘাট এলাকায়

আজ বুধবার সকালে দশালিয়া এলাকা থেকে ফিরে কয়রার কপোতাক্ষ পাড়ের আরেক গ্রাম মদিনাবাদ এলাকায় যান এই প্রতিবেদক। সেখানে দেখা যায়, গ্রামটির বহু মানুষ উৎকণ্ঠা নিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের আশঙ্কা, ঘূর্ণিঝড় দানা আঘাত হানলে বেড়িবাঁধটি উপচে কিংবা ভেঙে পুরো এলাকা লোনাপানিতে ভেসে যাবে।

মদিনাবাদ গ্রামের বাসিন্দা সোহাগ হোসেন বলেন, আগে ভরা জোয়ারে বাড়ির সামনের বাঁধের অর্ধেক পর্যন্ত পানি থাকত। এখন বাঁধ কানায় কানায় পূর্ণ হয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জোয়ারের পানি বাড়লে বাঁধ ছাপিয়ে লোকালয় লোনাপানিতে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কায় আছেন তাঁরা।

বুধবার দুপুরে দেখা গেছে, কয়রা উপজেলা পরিষদের পাশের মদিনাবাদ লঞ্চঘাটের দক্ষিণ পাশে নির্মাণাধীন বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটার কপোতাক্ষ নদে ধসে পড়েছে। নদে জোয়ারের চাপ বাড়লে ওই স্থান ভেঙে উপজেলা পরিষদসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হতে পারে।

কয়রা উপজেলার জনপ্রতিনিধি ও পাউবোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনটি নদ-নদীবেষ্টিত কয়রা উপজেলায় পাউবোর বেড়ি বাঁধ আছে ১৫৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে কয়রা সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা-ঘাটাখালী এলাকায় ১ কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি-দশহালিয়া এলাকায় ১ কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত ১ কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, শিকারিবাড়ি, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় ২ কিলোমিটারের মতো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত ২৬ ও ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের সময় অস্বাভাবিক জোয়ারের পানির চাপ ও বাতাসে অনেক স্থানে বেড়িবাঁধের নদীর দিকের অংশ ক্ষয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে যায়। কোথাও কোথাও ওপরের মাটি ধুয়ে বাঁধ নিচু হয়ে যায়। এরপর গত ৫ মাসেও তা সংস্কার না করায় বাঁধের অবস্থা আরও জরাজীর্ণ হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় দানা আঘাত হানার আগে মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না ওই বাঁধ। এ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন এলাকার মানুষ।

সুন্দরবন সংলগ্ন শাকবাড়িয়া নদীতীরবর্তী পাথরখালী গ্রামের বাসিন্দা পারুল রানী বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় নিজেদের বাড়িঘর জায়গাজমি সব শাকবাড়িয়া নদীতে বিলীন হয়েছে। সেই থেকে বাঁধের পাশে কোনোরকমে বসবাস করছি। প্রতিবছর একটা না একটা দুর্যোগ লেগেই আছে।

খুলনার কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ এলাকায় সদ্য নির্মিত এ বাঁধ ধসে গিয়ে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। এতে প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসী। আজ মদিনাবাদ এলাকায়

পারুল আরও বলেন, ‘শুনতিছি আবার বড় ঝড় আসতেছে। এবার ঝড়ে বেড়িবাঁধ ভাঙলি কনে যাব তার ঠিক নেই। গাঙের পাড়ে থাকবার মতো পরিবেশও এখন আর নেই।’

পারুল রানীর মতোই উপকূলীয় উপজেলা কয়রার অসংখ্য মানুষ ঘূর্ণিঝড় ডানা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। বিশেষ করে জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়েই তাঁদের উৎকণ্ঠা বেশি। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় দানার আতঙ্কে সুন্দরবনে মাছ শিকার করতে যাওয়া জেলেরাও নৌকা নিয়ে উপকূলে ফিরতে শুরু করেছেন। জেলেরা বলছেন, বনের পাশে বঙ্গোপসাগর ভয়ংকর রকম উত্তাল হয়ে ওঠায় উপকূলে ফিরে এসেছেন তাঁরা।

ঘূর্ণিঝড় দানা আগামীকাল বৃহস্পতিবার রাতে উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে জানান সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা আবহাওয়া অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হাসানুল বান্না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির অতিক্রম করার পথ আরও পরে নিশ্চিত হওয়া যাবে। অতিক্রমের সময় নদে জোয়ার থাকলে উপকূলের বেড়িবাঁধ ভাঙনের ঝুঁকি থাকবে। তখন নদে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু জোয়ার হওয়ার আশঙ্কা আছে। উপকূলীয় এলাকা এখনো ৩ নম্বর সংকেতের আওতায় আছে।

কয়রা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা রুলি বিশ্বাস জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা পেয়ে মোকাবিলার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। পর্যাপ্ত শুকনা খাবার ও সুপেয় পানির ব্যবস্থার পাশাপাশি উপজেলায় ১১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘এ মুহূর্তে কয়রার কয়েকটি এলাকার বাঁধের দুর্বল অংশে মেরামতকাজ চলমান আছে। তা ছাড়া দুর্যোগে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেখানে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আমাদের প্রস্তুতি আছে।’