কুড়িগ্রামে বাড়ছে পানি, তিন উপজেলায় পানিবন্দী ১০ হাজার পরিবার

ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে প্রথম আলো চরের তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বুধবার বিকেলে কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার রসুলপুরে
ছবি: প্রথম আলো

কুড়িগ্রামে ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে। জেলার প্রধান নদ-নদীগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও নিচু এলাকায় পানি বেড়েই চলেছে। সদর, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলার প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কুড়িগ্রাম কার্যালয়ের বুধবার সন্ধ্যা ছয়টায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জেলার প্রধান নদ-নদীগুলোর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার, হাতিয়া পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার এবং দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ সেন্টিমিটার ওপর প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া তিস্তা নদীর পানি কিছুটা বাড়লেও তা বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সরেজমিনে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের পোড়ারচর, গোয়ালপুরী, ঝুনকারচর, মাঝিয়ালীরচর, বারোবিশ, চর ভগবতীপুর ও খাসের চরের সাত হাজারের বেশি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এবং পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসতবাড়িতে পানি উঠেছে।

উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মশালেরচর, বতুয়াতলী, দক্ষিণ বালাডোবা, উত্তর বালাডোবা, রসুলপুর চরসহ বেগমগঞ্জ ইউনিয়নে দুই হাজার পরিবার পানিবন্দী, দুই শতাধিক বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মাঝের আলগা, ২৭ দাগের চর, মেকুরের আলগা, পূর্ব দইখাওয়া নামাপাড়া, আইরমারীর চর, নামাজের চর, সুখের বাতির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
চিলমারী উপজেলার নয়ারচর ইউনিয়ন, চিলমারী সদর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের প্রায় ৫টি চরে পানি উঠে দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। যাত্রাপুর ইউনিয়নের গাবেরতল এলাকায় যাত্রাপুর-কুড়িগ্রাম পাকা সড়ক বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

এসব এলাকার বাসিন্দাদের নৌকায় করে গারুহারাসহ মোল্লারহাটে যাতায়াত করতে দেখা যায়। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন, উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা, বেগমগঞ্জ, চিলমারী উপজেলার নয়ারহাট, অষ্টমীরচর ও ধরলা নদীর পানি বেড়ে রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়ন, ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী, বড়বাড়ি ইউনিয়ন ও দুধকুমার নদের পানি বেড়ে নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া, বেরুবাড়ী ও বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের শতাধিক চর প্লাবিত হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল ইসলাম জানান, দেশের উত্তরাঞ্চল ও উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টা ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। এতে কুড়িগ্রামের ধরলা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে স্বল্প মেয়াদে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
এদিকে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উজানের ঢলের স্রোতে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গাধর নদ-নদী অববাহিকায় তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় পশু চারণভূমি পানির নিচে ডুবে গিয়ে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে।

নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নের গরুভাসার চরের বাসিন্দা তাজেল উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, তিন দিন থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নুনখাওয়া ইউনিয়নের প্রায় ১০টি চরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া গরুভাসার চরে গঙ্গাধর নদের ভাঙনে এক সপ্তাহে শতাধিক বসতভিটা বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙনে বসতভিটা হারানো পরিবারগুলো অন্যের বাড়িতে ও স্কুলঘরে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জন্য শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হতো।

উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মাঝের আলগার চরের বাসিন্দা মাইদুল ইসলাম বলেন, গত তিন দিনের ভারী বৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে গোচারণভূমি ডুবে গিয়ে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে।

যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবদুল গফুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত কয়েক দিনের বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে সাত হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এবং পাঁচ হাজার বসতবাড়িতে পানি উঠেছে। এসব পরিবারের জন্য মাত্র চার মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছিলাম। আজ এসব চাল বিতরণ করা হয়েছে। সরকারিভাবে যে পরিমাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। বেসরকারিভাবে ত্রাণ না পৌঁছালে যাত্রাপুর ও ব্রহ্মপুত্র নদ এলাকার চরাঞ্চলের মানুষের কষ্টের সীমা থাকবে না।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্যার্তদের উদ্ধারের জন্য চারটি স্পিডবোট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও ইউনিয়নে ত্রাণ সরবরাহ করা হয়েছে। আমাদের কাছে নগদ অর্থ ও ত্রাণ পর্যাপ্ত রয়েছে। যেকোনো এলাকায় বন্যা ও ভাঙনের খবর পেলেই আমরা সেখানে দ্রুত ত্রাণ সরবরাহ করছি।’

ডিসি আরও বলেন, বুধবার উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নে ১০০ জনের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল এবং চিলমারীর রমনা, নয়ারহাট ইউনিয়নে মোট ৬ মেট্রিক টন চাল ৬০০ জন উপকারভোগীর মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় চরভগবতীপুর, খেয়ার আলগা, কালীর আলগা, পোড়ার চরে ১৫০ প্যাকেট ত্রাণ, নাগেশ্বরী উপজেলায় গরুভাসার চর, ফকিরগঞ্জ, চরকাপনা, নুনখাওয়ায় ২০০ পরিবারকে ১০ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, ১ লিটার তেল ও ১ কেজি করে লবণ দেওয়া হয়েছে।