এখনো ঝুঁকিতে শরণখোলা

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঘূর্ণিঝড় সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলায় নদীর তীর রক্ষায় ফেলা সিসি ব্লক ধসে পড়ছে। সম্প্রতি তোলা ছবি

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য যেসব দিন ভয়াবহ দুঃসহ যন্ত্রণার, তার মধ্যে অন্যতম ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডরে সেই দিন বাগেরহাটেই মারা যান ৯০৮ জন। এরপর কেটে গেছে ১৬টি বছর। সিডরে জেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলা এখনো ঝুঁকিতে আছে।

উপজেলার বগী এলাকার বাসিন্দা সোহাগ ২০০৭ সালে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৬ বছর আগের সেই ভয়ংকর দিনটির কথা বলতে গিয়ে সোহাগ বলেন, ‘ঝড় বা সিগন্যাল তো আর বুঝতাম না।

বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি যাই। ভিজে বাড়ি ফেরায় মা রাগও করে। সন্ধ্যার পরে হঠাৎ গতি বেড়ে যায় বাতাসের। সেই রাতে মায়ের কোল ঘেঁষে বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর ঘরের মধ্যে পানি উঠতে থাকে। দ্রুত পরিবারের সাত সদস্য পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিই। মায়ের সঙ্গে যে বাড়ি ছিলাম, সেই বাড়ির ঘরের মধ্যে পানি উঠতে থাকে। লোকজনের ডাক-চিৎকারে সবাই বাইরে আসি।

চারদিকে তখন পানি আর কচুরিপানা। অন্ধকারের মধ্যেই পরিবারের সদস্যরা হাত ধরাধরি করে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ স্রোতের তোড়ে আমার হাত ছুটে যায়। কী করব, বুঝতে পারছিলাম না, ভালো সাঁতারও জানি না। এর মধ্যে বড় একটি ঢেউ আমাকে ছুড়ে ফেলে মোটা একটি গাছের ওপরে। সেই গাছ ধরেই বেঁচে যাই। পরদিন সকালে নেমে এসে পরিবারের সদস্যদের খুঁজতে থাকি। কিন্তু মা-বাবাসহ ৬ জনকে আর খুঁজে পাইনি। ৪ দিন পর মায়ের ও ১০ দিন পর বাবার মরদেহ খুঁজে পাই।’

একই এলাকার দিনমজুর নূর ইসলামের বয়স এখন ৪৮ বছর। সিডরের সময় ঘরে স্ত্রীসহ দেড় ও পাঁচ বছর বয়সী ছেলে-মেয়ে তাঁর। সেই রাতের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে বাতাস এল। নিমেষেই সব উড়িয়ে নিয়ে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চারদিকে পানি আর পানি। মুহূর্তের মধ্যে সব তলিয়ে গেলে ঘরের সামনে বাঁধা গরু-বাছুরের দড়িও খুলে দিতে পারিনি। ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই।

তখন ঘরের ওপরের টিন খুলে ফেলি। একে একে সবাইকে বের হয়ে গাছ ধরতে বলি। ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সারা রাত গাছের ওপর বসে থাকা কতটা যন্ত্রণার, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কয়েকবার মনে হয়েছে, এই বুঝি হাত ছুটে কেউ পানিতে পড়ে গেল। অবশেষে দুঃসহ রাত শেষ হয়। সকালে দেখি, ঘরবাড়ি কিছু নেই। লোকজন সব কান্নাকাটি করছে। পথের সামনে তিনটি মরদেহ। কিছু দূরে আরও আটটি। সেই রাতের কথা মনে পড়লে এখনো ঘুমের ঘোরে জেগে উঠি।’

স্থানীয় ব্যক্তিদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে প্রমত্ত বলেশ্বরের তীরে ৬২ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে। ওই বাঁধ নির্মাণ হওয়ায় আশায় বুক বাঁধেন উপকূলবাসী। তবে তাঁদের সব আশা হতাশায় রূপান্তর করে ভাঙন ধরেছে সেই টেকসই বেড়িবাঁধে।

চলতি বছরের অক্টোবর মাসে উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা আশার আলো মসজিদ থেকে ডিএস-৭ স্লুইসগেট পর্যন্ত ২০০ ফুটের বেশি রিংবাঁধ এবং মূল বাঁধের নিচে বেশ কিছু সিসি ব্লকও নদের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। একই সঙ্গে প্রবল ভাঙনে নদের গর্ভে বিলীন হয়েছে অন্তত ১০ একর ধানি জমি। ফাটল ও ভাঙন অব্যাহত থাকায় বাধ্য হয়ে ভেঙে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বাঁধের পাশে থাকা দোকান। এই অবস্থায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাঁধের বাইরে থাকা শতাধিক পরিবার ও কয়েক শ একর জমি।

 গত বছর মে মাসে শরণখোলা উপজেলার গাবতলা বাজারসংলগ্ন বেড়িবাঁধ ১৫-২০ ফুট লম্বা ফাটল দেখা যায়। এর আগে ফেটে যাওয়া এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা গাবতলা গ্রামের ছফেদ খানের ১০ কাঠা জমি গাছপালাসহ নদে বিলীন হয়ে যায়।