বিস্ফোরণের পর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৮৭ দশমিক ৫০ একর।
১৯৯৭ সালের ১৪ জুনের মধ্যরাত। হঠাৎ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান-সংলগ্ন মাগুরছড়া এলাকা আগুনের শিখায় ঝলসে ওঠে। দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুন প্রায় ৫০০ ফুট উঁচুতে উঠে যায়। বনজুড়ে পাখি ও প্রাণীরা প্রাণ বাঁচাতে এদিকে-ওদিকে ছুটতে থাকে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বনের চারপাশে।
২৬ বছর আগে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এতে শুধু মাগুরছড়া গ্যাসকূপের নয়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের গাছপালা ও পশুপাখির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। এ বিস্ফোরণের পর জাতীয় উদ্যান থেকে অনেক বিরল প্রাণী, পাখি ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ হারিয়ে গেছে।
লাউয়াছড়া পুঞ্জির (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গ্রাম) বাসিন্দা, খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের তথ্য ও প্রচারবিষয়ক সম্পাদক সাজু মারছিয়াং গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ২৬ বছর পরও মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের ক্ষত বয়ে চলেছে লাউয়াছড়া বন। যদিও খালি চোখে সেই ক্ষতচিহ্ন এখন আর দেখা যায় না। দগ্ধ এলাকায় নতুন করে বনায়ন করেছে বন বিভাগ। কিন্তু এখনো বিস্ফোরণের কথা মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে পুঞ্জির খাসিয়াদের।
বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ খননের সময় এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। অক্সিডেন্টাল নামের একটি বিদেশি কোম্পানি এ কাজ করছিল। আগুনের তাপে উদ্যানের ভেতরে থাকা ঢাকা-সিলেট রেলপথ, শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ সড়ক, ফুলবাড়ী চা-বাগান, মাগুরছড়া খাসিয়া পানপুঞ্জি, শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ভানুগাছ বিদ্যুৎ-লাইনসহ গ্যাসকূপ–সংলগ্ন এলাকা পুড়ে যায়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের মূল্যবান সেগুন প্রকৃতির গাছ, বাঁশ, অন্যান্য প্রজাতির বৃক্ষ, বৃক্ষলতায় আচ্ছাদিত ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৮৭ দশমিক ৫০ একর।
বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি কূপ খননকারী প্রতিষ্ঠান অক্সিডেন্টাল কোম্পানির অবহেলাকে দায়ী করে প্রতিবেদন দিয়েছিল। প্রতিবেদনে দুর্ঘটনায় বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য ২৪৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। তখন অক্সিডেন্টালের কাছে ১৪ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
বিস্ফোরণের পরে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি তাঁদের প্রতিবেদনে বন পুনর্বাসনের জন্য ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে। কিন্তু সে টাকা পাওয়া গেছে কি না তা জানাতে পারেননি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা।
বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ক্ষতিপূরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য তাঁর জানা নেই।
প্রাণ-প্রকৃতি গবেষক পাভেল পার্থ মাগুরছড়া গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের আগে ও পরের অবস্থা নিয়ে বলেন, এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে লাউয়াছড়াতে বেশ কিছু লতাগুল্মজাতীয় উদ্ভিদ, পাখি, সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণী দেখা যাচ্ছে না। অগ্নিকাণ্ডের আগে লাউয়াছড়া বন ও বনের ভেতরে রেলপথের পাশে ‘নিটাম’ নামের একধরনের নগ্নবীজী উদ্ভিদ প্রচুর ছিল। এখন নেই। এ ছাড়া প্রচুর ফার্ন, ছত্রাক ও শৈবাল ছিল। এগুলো স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকে। সেগুলো এখন অনেক কম দেখা যায়। ‘লুমিনা ফানজাই’ নামের একজাতের ছত্রাক থেকে অন্ধকারে আলো বের হতো। খুবই দুর্লভ এই ছত্রাক এখন আর দেখা যায় না। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ভাষায় ‘কুটুই রুগ্নি ক্লুম’ নামের সাদা ফুলের একটি গাছ আছে। এই গাছও এখন দেখা যায় না। লাউয়াছড়ায় অনেক পাখি এখন আর দেখা যায় না। পাখির আবাসস্থল ওলটপালট হয়ে গেছে। অনেক পাখি এখান থেকে সরে গেছে। লাউয়াছড়ার চেয়ে পাশের কালাছড়া বনে এখন অনেক বেশি পাখি দেখা যায়।
পাভেল পার্থ বলেন, বনের প্রাণ-প্রকৃতির সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না। এটি একটি বড় বিপদের বিষয়।