প্রথম দিকে আশপাশের জেলা থেকে এসব ককটেল-আগ্নেয়াস্ত্র কিনে আনা হলেও বর্তমানে স্থানীয় বাসিন্দারা এসব তৈরি করছেন।
মেঘনা নদীবেষ্টিত নরসিংদী সদর উপজেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের আলোকবালী ইউনিয়ন সব সময়ই টেঁটাযুদ্ধের জন্য আলোচিত ছিল। তবে সম্প্রতি টেঁটার ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের প্রতি ঝুঁকেছেন গ্রামের বাসিন্দারা। ৯টি গ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিভক্ত মানুষের হাতে হাতে এখন আগ্নেয়াস্ত্র। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, আলোকবালীর মানুষ এখন আর টেঁটাবিদ্ধ হন না, গুলিবিদ্ধ হন।
গত বুধবার ভোরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ১৬ জন গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া ১৫–২০টি বাড়িঘরও ভাঙচুর করা হয়। ইউনিয়নের বাখরনগর, মুরাদনগর ও বকশালীপুর গ্রামে দফায় দফায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধ ১৬ জন নরসিংদী সদর হাসপাতাল, ১০০ শয্যাবিশিষ্ট নরসিংদী জেলা হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, আলোকবালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদ উল্লাহর পক্ষের সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে গত দুই বছরে পাঁচজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন।
দুই পক্ষের অন্তত ২০ নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিছুদিন আগেও সংঘর্ষ লাগলে এক পক্ষ টেঁটা-বল্লম নিয়ে আরেক পক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। বছরখানেক ধরে এসব দেশীয় অস্ত্রের জায়গা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আর ককটেল। প্রথম দিকে আশপাশের জেলা থেকে এসব ককটেল-আগ্নেয়াস্ত্র কিনে আনা হলেও বর্তমানে স্থানীয় বাসিন্দারা এসব তৈরি করছেন। শুধু ছররা গুলি আর গানপাউডার বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে মানুষ দুটি ভাগে বিভক্ত। তাঁদের হাতে কম করে হলেও পাঁচ শতাধিক আগ্নেয়াস্ত্র আছে, যেগুলো সংঘর্ষ বাধলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য আড়াই বছর আগে একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প করা হয়। কিন্তু তারা সবকিছু দেখেও দেখে না।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, আগে পারিবারিক, বংশগত কারণে সংঘর্ষ বাধলেও এখন পুরোপুরি রাজনৈতিক। আসাদ উল্লাহ ও দেলোয়ার হোসেনের বিরোধ দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরসিংদী-১ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের (নৌকা প্রতীক) পক্ষে দেলোয়ার হোসেন কাজ করেন। আর আসাদ উল্লাহ কাজ করেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুজ্জামানের পক্ষে। জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বিজয়ী হন। পরাজিত কামরুজ্জামান জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র। এ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে দফায় দফায় দুই গ্রুপের মধ্যে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ হলে দেলোয়ারের লোকজন আসাদ উল্লাহ গ্রুপের বেশ কিছু সমর্থককে এলাকাছাড়া করেন।
বুধবার ভোর পাঁচটার দিকে আসাদ উল্লাহ পক্ষের এলাকাছাড়া লোকজন বাখরনগর গ্রামে প্রবেশ করতে চাইলে দেলোয়ারের লোকজন বাধা দেন। এ সময় উভয় গ্রুপের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে গোলাগুলি শুরু করেন। কাছাকাছি সময়ে ইউনিয়নের মুরাদনগর ও বকশালীপুর গ্রামেও এলাকাছাড়া লোকজন প্রবেশের সময় দেলোয়ারের সমর্থকেরা বাধা দিলে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। একযোগে তিন গ্রামে সংঘর্ষ চলাকালে উভয় পক্ষের অন্তত ১৬ জন শটগানের গুলিতে আহত হন। এ ছাড়া এলাকাছাড়া লোকজনের ১৫–২০টি বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাখরনগর, মুরাদনগর, বকশালীপুর, আলোকবালী, কাজীরকান্দি, নেকজানপুর, বীরগাঁও, সাতপাড়া ও খোদাদিলা—এই ৯ গ্রাম মিলে আলোকবালী ইউনিয়ন। চারদিক থেকে মেঘনা নদীবেষ্টিত এই চরাঞ্চলে নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো পথ নেই।
আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে আলোকবালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদ উল্লাহ এবং ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। দুজনের কেউ কল ধরেননি। এসএমএস ও হোয়াটস অ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি।
এর আগে সংঘর্ষের পর আসাদ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দল বেঁধে আমাদের লোকজনের ওপর হামলা চালিয়ে ছয়জনকে গুলি করে আহত করেছেন। আমরা সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুজ্জামানের নির্বাচন করেছিলাম। নির্বাচনের দিনই ২০ জনকে এলাকাছাড়া করেন তাঁরা।’
দেলোয়ার হোসেনের গ্রুপের নেতা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোমেন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসাদ উল্লাহর অত্যাচার থেকে বাঁচতে সাধারণ লোকজন তাঁদের প্রতিহত করে এলাকা থেকে বের করে দিয়েছিলেন। আজ তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এলাকায় ঢুকে হামলা চালান।’
জানতে চাইলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সংঘর্ষের ওই ঘটনায় আমাদের কাছে একপক্ষ লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। জড়িত প্রত্যেককে গ্রেপ্তার করা হবে।’ স্থানীয়ভাবে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করে সংঘর্ষের সময় ব্যবহারের বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও আরও তৎপর হতে বলেছি।’