তবু অপেক্ষায় থাকেন নাসিমা-ডরোথি

শহীদ এইচ এম ইব্রাহিম সেলিম ও তাঁর স্ত্রী নাসিমা জেসমিন
ছবি: পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগৃহীত

১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করে। মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া এলাকায় পৌঁছানোর পর পুলিশের ট্রাক মিছিলকারীদের ওপর উঠে যায়। ট্রাকচাপায় নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রনেতা—এইচ এম ইব্রাহিম সেলিম ও কাজী দেলোয়ার হোসেন। তাঁদের স্মরণে দিনটি শহীদ সেলিম-দেলোয়ার দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

৪০ বছর পরও তাঁদের পরিবার-স্বজনেরা তাঁদের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছেন। বরিশাল নগরের কাউনিয়া এলাকায় শহীদ ইব্রাহিম সেলিমের স্ত্রী ও মেয়ের বসবাস। গত শনিবার বিকেলে বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, পুরো একতলা বাড়িটা জরাজীর্ণ। ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ে রড বের হয়ে আছে। ঘরে আসবাব বলতে ভাঙাচোরা একটি সোফা, একটা টেবিল, পুরোনো খাট। ভেতরটা অন্ধকার। ঘরের বাসিন্দা তিনজন—ইব্রাহিম সেলিমের স্ত্রী নাসিমা জেসমিন, মেয়ে নুসরাত ডরোথি ও নাসিমা জেসমিনের মা।

নাসিমা জেসমিন বলেন, বিয়ের মাত্র দুই বছরের মাথায় স্বামীকে হারান। এর পর থেকে ছয় মাস বয়সী একমাত্র মেয়ে নুসরাত ডরোথিকে নিয়ে শুরু হয় তাঁর জীবনের কঠিন সংগ্রাম। ডরোথি এখন বড় হয়েছে। কিন্তু সংগ্রামটা থামেনি।

কথা বলে জানা যায়, নাসিমা জেসমিনের বাবা আতিকুল্লাহ ছিলেন পটুয়াখালীর বাউফল থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। পরিবারের সঙ্গে সেখানের সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন তাঁরা। তাঁর বড় ভাই খাইরুল আনামের বন্ধু ছিলেন ইব্রাহিম সেলিম। সেই সুবাদে তাঁদের বাসায় আসতেন সেলিম। সেই থেকেই দুজনের পরিচয়, প্রেম। সেলিম ঢাকা থেকে রঙিন খামে শুকনো গোলাপের পাপড়ি মোড়ানো চিঠি লিখে পাঠাতেন জেসমিনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বরিশাল শহরের বটতলা এলাকার বাসার ঠিকানায়। সেখান থেকে চিঠি নিয়ে পড়তে গিয়ে ধরা পড়েছেন মায়ের কাছে। শুনেছেন বকুনিও।

পরে ১৯৮২ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে জেসমিন বরিশালে এসে বিয়ে করেন সেলিমকে। সেলিম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতেন সূর্য সেন হলে। সেলিম বেকার হওয়ায় তাঁদের বিয়ে প্রথমে মেনে নেয়নি নাসিমা জেসমিনের পরিবার।

সেলিম–নাসিমা দম্পতির মেয়ে নুসরাত ডরোথি

২৮ ফেব্রুয়ারির কথা বলার সময় নাসিমা জেসমিনের চোখ ভিজে আসে। সেলিম যেদিন শহীদ হন, সেদিনই এ খবর পেয়েছিলেন তাঁর বড় ভাই খায়রুল আনামের কাছে। তিনি জেসমিনকে বরিশাল থেকে লঞ্চে বাউফলে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যান। মেয়ে ডরোথির বয়স তখন মাত্র ছয় মাস। স্বামীর মৃত্যুর পর এরশাদ সরকারের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রত্যাখ্যান করেছিলেন জেসমিন।

সেলিম শহীদ হওয়ার পর নাসিমার বাবা তাঁকে আবার আপন করে নেন। কিন্তু মা হাসনাহেনার রাগ পড়েনি তখনো। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর তিনি মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছিলেন ১৫ বছর পর।

স্বামীর মৃত্যুর পর সংগ্রামটা কেমন ছিল?—জানতে চাইলে নাসিমা বলেন, মেয়েকে নিয়ে তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। শুরু করেন পড়াশোনা। ভর্তি হন বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজে। এই কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ থেকে স্নাতক করেন। এরপর আর পড়াশোনা এগিয়ে নিতে পারেননি। সংসারের হাল ধরতে হয়েছে।

স্বামীর স্মৃতিচারণা করে জেসমিন বললেন, ‘সেলিমকে এভাবে হত্যা করা হবে, বুঝতে পারিনি। বিশাল বিত্তবৈভবের স্বপ্ন ছিল না সেলিমের। স্বপ্ন ছিল সততার সঙ্গে সচ্ছলতা নিয়ে ঢাকায় বসবাস করার।’ শহীদ সেলিমের সঙ্গে তাঁর বিয়ের পর অল্প সময় কেটেছে। সেগুলো এখন মধুর স্মৃতি।

নাসিমা জেসমিনের বয়স এখন ৬৩ বছর। স্বামীর বাড়ির সম্পত্তি দখলে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ তাঁর। তাই বাবার কবরও জিয়ারত করতে যেতে পারেন না মেয়ে ডরোথি। এখন সংসার চলে ডরোথির চাকরির টাকায়। ডরোথি অনেক কষ্টে বড় হয়েছে। নবম শ্রেণির পর ডরোথির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। ডরোথি এখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলের কর্মচারী (অফিস সহায়ক) হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এই পদে যোগ দেন।

বরিশালে যে বাড়িতে এখন তাঁরা বসবাস করছেন, সেটি নাসিমা জেসমিনের পৈতৃক বাড়ি। নাসিমা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদের ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দিয়েছিলেন, সেখান থেকে পাওয়া লাভের টাকা ও মেয়ের আয়ে তাঁদের সংসার চলে। মেয়েকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি, ঘরসহ ১৫ শতাংশ জমি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তবে ওই জমি বরিশাল শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় সেখানে থাকেন না তাঁরা।

মায়ের মুখে বাবার কথা শুনে ডরোথি অনেকটা আপ্লুত পড়েন। ডরোথির আক্ষেপ, সমাজ তাঁর বাবাকে ভুলে গেছে। তিনি চান তরুণ প্রজন্ম জানুক, কেন তাঁর বাবা এবং তাঁর সহযাত্রীরা জীবন দিয়েছেন। ফেরার আগে ডরোথি বললেন, ‘বাবা ছাড়া পৃথিবীটা কত কঠিন, তা আমার মতো যাঁরা, তাঁরাই কেবল অনুধাবন করতে পারেন। জানি বাবা আর কখনো ফিরবেন না। তবু এখনো বাবার জন্য অপেক্ষা করি। যদি কখনো এসে একটু মা বলে ডাক দেন, সেই অপেক্ষায় থাকি!’