‘১৫ দিন হয় বানের পানি আসি ঘরোত উঠছে। এল্যা ঘরোত সাঁতারপানি। উপায় না পায়া ছাওয়া-পাওয়া (ছেলেমেয়ে) ধরি গোয়াল ঘরোত উঠছি। সারা দিন নৌকাত থাকি, রাইতোত গরুর সাতে গোয়াল ঘরোত ঘুমাই। ছোডো নৌকাত ছাওয়া-পাওয়া নিয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকা যায় না। আকাশ থাকি ঝড়ি (বৃষ্টি) পড়ে, শোঁ শোঁ করি বানের পানি ডাকে ছাওয়া-পাওয়া ভয় পায়। বাইদ্দ হয়া গরু–মানুষ একসাতে থাকপের নাগছি। বানের পানিত চুলা ডুবি যায়া রান্না–খাওয়া সব বন্ধ হয়া আছে। তোলা চুলাত রান্না করি। এক বেলা খাই, দুই বেলা অইদনে (উপাস) থাকি।’
কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মুসার চর এলাকার বাসিন্দা রাবেয়া বেগম (৫০)। ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে জেলার সব নদ-নদীর পানি বেড়ে পনেরো দিন তাঁর বসতবাড়ি তলিয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে অসুস্থ স্বামী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে গোয়ালঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। একই অবস্থা বতুয়াতলীর চরের বাসিন্দা ছবুরা বেগমেরও।
ছবুরা বলেন, ‘ঘরোত এক গলা পানি, থাকি ক্যাদন করি। এক সপ্তাহ থাকি নৌকাত রাত কাটাই। ঘরোত খাবার কিছু নাই। নিজে খাবার পাই না। এর মধ্যে দুইডা ছাগল আছে, তাগো খাওন দিমু কী? ঘাস তো পানির নিচে। এহন ছাগল বাঁচানো দায় হইয়া গেছে।’
গতকাল সোমবার বিকেলে কুড়িগ্রাম শহর থেকে উলিপুর উপজেলা হয়ে চিলমারী এলাকার বন্যা পরিস্থিতি ঘুরে দেখেন এই প্রতিনিধি। উলিপুর উপজেলা পার হয়ে চিলমারী সড়ক দিয়ে নদী বন্দরে যেতেই সড়কের দুই পাশের জনপদ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। চিলমারী সদর ইউনিয়নের মানুষ মারার চর, কড়াই বরিশাল, গাজীপাড়া, আমতলী, চর শাখাহাতি; রমনা ইউনিয়নের বাসন্তি গ্রাম, তেলিপাড়া, খড়খড়িয়া, মাঝিপাড়া, ব্যাপারীপাড়া, ব্যাঙমারা চরে বুক সমান পানি জমে আছে। চরের বাসিন্দারা কেউ নৌকায়, আবার কেউ ঘরের ভেতর চৌকি উঁচু করে কোনো রকম বসবাস করছেন।
ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে রমনা ইউনিয়নের ১০ হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দী। এ পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮০০টি পরিবারে ১০ কেজি করে চাল ও জেলা প্রশাসনের ৬০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। চারদিকে পানিবন্দী মানুষের হাহাকার। এত অপর্যাপ্ত ত্রাণ দিয়ে কিছুই হয় না।রমনা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. গোলাম আশেক
বাসন্তি গ্রামে নৌকায় ওপর দেখা মেলে তাপসী রানীর (৩২)। হাতে থাকা একটি এনজিওর কিস্তির বই দেখিয়ে প্রথম আলোর প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘গত বুধবার ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় উথলায় বাড়িত পানি উঠছে। এল্যা ঘরত কোমর পানি। দুইমাস আগে এনজিও থাকি ৪০ হাজার টাকা কিস্তি নিছিলং। বৃহস্পতিবার আসলেই এক হাজার টাকা করে কিস্তি দেওয়া নাগে। পাঁচ দিন ধরি বেডাছাওয়ার (স্বামী) মাছধরা বন্ধ আছে। এল্যা নিজেরা খাই কী, আর কিস্তির টাকা দেই ক্যাদন করি? এ্যালাও কোনো ত্রাণ পাই নাই।’
ত্রাণ সংকটের কথা অকপটে স্বীকার করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রমনা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. গোলাম আশেক। তিনি জানান, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বেড়ে রমনা ইউনিয়নের ১০ হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দী। এ পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮০০টি পরিবারে ১০ কেজি করে চাল ও জেলা প্রশাসনের ৬০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। চারদিকে পানিবন্দী মানুষের হাহাকার। এত অপর্যাপ্ত ত্রাণ দিয়ে কিছুই হয় না।
উজানের পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের ১৬টি নদ-নদীর পানি বেড়ে ৯ উপজেলার ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৩৯ বাসিন্দা পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জেলার ২৯০টি প্রাথমিক ও ১০৩টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিলমারী উপজেলার রাণীগঞ্জ ইউনিয়নের কাঁচকোল এলাকায় বন্যার পানির স্রোতে গত শুক্রবার ব্রহ্মপুত্র তীর রক্ষা বাঁধের দুই জায়গায় ধস নামে। এ ছাড়া নাগেশ্বরী উপজেলার বামডাঙ্গা ইউনিয়নের মিয়াপাড়া এলাকার পুরাতন বেড়িবাঁধটির ১০০ মিটার ভেঙে গেছে। বন্যার পানি বেড়ে সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলা শহরের সঙ্গে কচাকাটা থানার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, উজানের পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের ১৬টি নদ-নদীর পানি বেড়ে ৯ উপজেলার ১ লাখ ৩৫ হাজার ৯৩৯ বাসিন্দা পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। জেলার ২৯০টি প্রাথমিক ও ১০৩টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে উজানের ঢলের কারণে কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। গত দুই দিনের তুলনায় গতকাল সকাল থেকে নদ-নদীর পানি কিছুটা কমলেও ধরলা, ব্রহ্মপুত্র ও দুধকুমার নদের পানি গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপৎসীমার ওপরে আছে।
গতকাল সন্ধ্যায় ৬টায় জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ধরলা নদীর পানি সদর পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার, তালুক শিমুলবাড়ী পয়েন্টে ৭ সেন্টিমিটার, দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি নুনখাওয়া পয়েন্টে ৩৯ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ৫১ সেন্টিমিটার এবং হাতিয়া পয়েন্টে ৪১ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া তিস্তা নদী পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবদুল হাই সরকার প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত আছে এবং বিতরণও অব্যাহত আছে। এ পর্যন্ত ৩৯৭ মেট্রিক টন চাল, ২১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও ২১ হাজার ৩৩০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।