ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৫ আগস্ট হবিগঞ্জ শহরে গুলিবিদ্ধ হন সালেহ আহমদ (৫৫)। ওই দিন রাতেই তাঁকে সিলেটে আনা হয়। ২৫ দিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকার পর গত বৃহস্পতিবার তাঁকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। এখন টাকার অভাবে সালেহের চিকিৎসা চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবার।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সালেহ আহমদ। গতকাল রোববার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের পঞ্চম তলার ৫১৫ নম্বর কেবিনে শয্যায় শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন তিনি। তাঁর পেট ব্যান্ডেজ করা। পাশে বসে আছেন স্ত্রী হালিমা খাতুন। আরেক বিছানায় চুপচাপ বসে আছেন সালেহের মা ও তিন ছেলে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে পেরে সালেহ চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেন, ‘ওই দিন (৫ আগস্ট) আনোয়ারপুর পয়েন্টে (হবিগঞ্জ শহরে অবস্থিত) দুধ বেচতাম গেছলাম। আতকা শুনি কুললু (হইহুল্লোড়)। দেখার লাগি একটু আগাই যাই। এরপরই গুলি লাগে পেটে। চিকিৎসা করাইতে গিয়া আর কুলাইতাম পারতাছি না।’
সালেহের বাড়ি হবিগঞ্জ সদরের রাজনগর গ্রামে। বাড়িতে দুটি গরু ছিল। দুধ বিক্রি করে সংসার চালাতেন। এ ছাড়া অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করেন। সংসারে তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে ও মা। ১৩ বছর ও ১১ বছর বয়সী বড় দুই ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে। সাত বছর বয়সী ছোট ছেলেটি এখনো বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়নি। আর্থিক টানাপোড়েন থাকলেও তাঁদের ছোট সংসার ভালোই চলছিল। ৫ আগস্ট তাতে ছন্দপতন ঘটে। চিকিৎসার জন্য এরই মধ্যে দুটি গরু বিক্রি করেছেন। জমানো সঞ্চয়ও শেষ। এখন প্রতিদিন কেবল ওষুধ বাবদই তাঁর খরচ হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা।
সালেহ আহমদের বাড়ি হবিগঞ্জ সদরের রাজনগর গ্রামে। ৫ আগস্ট হবিগঞ্জ শহরে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। চিকিৎসার জন্য এরই মধ্যে দুটি গরু বিক্রি করেছেন। জমানো সঞ্চয়ও শেষ। এখন প্রতিদিন কেবল ওষুধ বাবদই তাঁর খরচ হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা।
হালিমা খাতুন টিস্যু দিয়ে সালেহের চোখের পানি মুছে দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট এ প্রতিবেদককে দেখান। এ সময় হালিমার চোখ দিয়েও পানি ঝরতে থাকে। চোখ মুছতে মুছতে হালিমা বলেন, ‘আমরার সম্বল বলতে আছিল দুইটা গরু। গরুর দুধ বেইচাই সংসার চলত। উপায় না দেইখা এই দুইটা গরু দেড় লাখ টাকায় বেচছি। ঘরে সঞ্চয় আছিল ৫০ হাজার টাকা। সেই টাকাও চিকিৎসাত লাগাইছি। এখন মাইনষের দান-খয়রাতে চিকিৎসা কুনুমতে চলতাছে।’
হালিমার স্বামীর চিকিৎসার খরচের হিসাব জানাতে গিয়ে আরও বলেন, ‘হাসপাতালের ডাক্তার আর পরিচিতজনেরা মায়া কইরা আরও দুই লাখ টাকা দান করছইন। সেই টাকাও চিকিৎসাত ব্যয় হইছে। এখনো হাসপাতালে আমরার কাছে পায় ৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। সামনে তো আরও দিন রইয়া গেছে। প্রতিদিন গড়ে ১৫ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। এ মুহূর্তে হাতে আছে ৪-৫ হাজার টাকা। কাইল (আজ সোমবার) ওষুধ ক্যামনে কিনমু, সেই চিন্তায় আছি। চিকিৎসা শেষে বাড়ি গিয়া ক্যামনে সংসার চলব, দুশ্চিন্তায় আছি।’
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছেড়ে চলে যান। ওই দিন দুপুরে হবিগঞ্জ শহরের আনোয়ারপুর পয়েন্টে দুধ বিক্রি করতে যান সালেহ আহমদ। তিনি জানান, সেখানে তখন আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে প্রতিরোধ করতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা গুলি ছোড়েন। এ সময় একটি বুলেট এসে তাঁর পেটে লাগে।
হালিমা খাতুন জানান, দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে তাঁর স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়েছিলেন। স্থানীয় কয়েকজন তাঁকে চিনতে পেরে বাড়িতে খবর দেন। বেলা আড়াইটার দিকে হালিমাসহ অন্যরা গিয়ে সালেহকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান। তখন তাঁর প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। চিকিৎসকেরা উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁদের সিলেটে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে দুজন শুভাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতায় নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সালেহকে ভর্তি করা হয়।
বর্তমানে তিনি (সালেহ) আশঙ্কামুক্ত। তাঁর খাদ্যনালি কেটে অস্ত্রোপচার করায় তাঁকে প্রথম ১০ দিন আইসিইউতে রাখতে হয়। এখন শঙ্কামুক্ত হওয়ায় আবার কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে।আবদুল্লাহ আল মাহাদী, নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা
সালেহ আহমদের শারীরিক অবস্থা এখন অনেকটাই ভালো বলে জানিয়েছেন নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মাহাদী। তিনি বলেন, বর্তমানে তিনি (সালেহ) আশঙ্কামুক্ত। তাঁর খাদ্যনালি কেটে অস্ত্রোপচার করায় তাঁকে প্রথম ১০ দিন আইসিইউতে রাখতে হয়। পরে কেবিনে স্থানান্তর করা হলেও ফের শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তখন তাঁকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। এখন শঙ্কামুক্ত হওয়ায় আবার কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে।