তেলমাখা চুলে চিরুনি করা। পরনের পরিষ্কার পুরোনো শার্ট ও স্যান্ডেলের সঙ্গে ঝকঝকে নতুন লুঙ্গি পরে পরিপাটি হয়ে ভ্যানের ওপর যাত্রীর অপেক্ষায় বসে ছিলেন শাহ মিয়া (৫৫)। চোখেমুখে চিন্তার ভাঁজ। এগিয়ে যেতেই গাল থেকে হাত নামিয়ে বললেন, ‘কোথায় যাবেন বাবা? চলেন নিয়ে যাই। ঈদের দিন বেশি ভাড়া নিব না। আগের যে ভাড়া সেই ভাড়াই দিয়েন।’
পবিত্র ঈদুল আজহার দিন বিকেলে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের তারাগঞ্জের ইকরচালী বাসস্ট্যান্ডে এভাবেই যাত্রীর অপেক্ষা করছিলেন শাহ মিয়া। বাড়ি রংপুর সদরে। রংপুর সদরের পাগলাপীর থেকে তারাগঞ্জের ইকরচালী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত প্যাডেলচালিত ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন।
স্ত্রী ও চার ছেলেমেয়ে নিয়ে শাহ মিয়ার সংসার। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ভ্যান চালানো আয় দিয়ে সংসার চালান তিনি। ভ্যানটি একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে (এনজিও) ঋণ নিয়ে কিনেছেন। এ জন্য সপ্তাহে হাজার টাকা কিস্তি দিতে হয়।
কোরবানির ঈদের কথা শুনে শাহ মিয়া বললেন, ‘বাবা, হামার গরিবের কি আর কোরবানি আছে? যে টাকা কামাই করি কিস্তি আর চাল কিনতে শ্যাষ। সকালে বাসি ভাত খায়া ভ্যান নিয়া বাইর হছু। সারা দিন কামাই করি মাংস কিনিয়া বেটির বাড়িত পটপার (পাঠাতে) নাগবে। এ্যালাও ৫০০ টাকাও কামাই হয় নাই। খুব চিন্তাত পড়ি গেছু।’
শাহ মিয়ার সঙ্গে কথা শেষ না হতেই তারাগঞ্জের পোদ্দারপাড়া গ্রামের আরেক ভ্যানচালক মন্টু মিয়া (৬৫) বলেন, ‘তোমরা একনা ভালো করি ভাবো তো। হামার যদি ঈদ থাকিল হয়, তা হইলে কি ঈদের দিনোত ভ্যান নিয়া ভাড়া খাইটপের বেরাই। হামার খাঁটি খাওয়াটায় ঈদ। হামার মতো গরিবের ঈদ হইতো বয়লার (ব্রয়লার) মুরগিত। এ্যালা সেই মুরগিত ভাগ বসাইছে বড় লোকেরা। এই কারণে বয়লারের দাম বাড়ি গেইচে। হামরা সেটাও কিনি খাবার পাওচি না।’
শুধু শাহ মিয়া ও মন্টু মিয়াই নন; তাঁদের মতো খেটে খাওয়া অনেকেই ঈদুল আজহার দিনে নামাজ শেষে জীবিকার তাগিদে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের কেউ কেউ ঈদের দিনেও গোশত খেতে পারেননি।
তারাগঞ্জের বালাবাড়ি বাজারে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক নিয়ে যাত্রীয় অপেক্ষায় ছিলেন আজিজুল ইসলাম। তিনি জানান, এনজিওর টাকা দিয়ে ইজিবাইক কিনেছেন। প্রতি বৃহস্পতিবার তাঁকে কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। এক দিন গাড়ি না চালালে ভাত জোটে না। এ জন্য ঈদের দিনও গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন। ঈদে তাঁরা ব্রয়লার মুরগির গোশত কিনে খান।
ছুটমেনানগর গ্রামের ভোদা মিয়ার স্ত্রী-সন্তানসহ পাঁচ সদস্যের পরিবার। তাঁর একার আয়ে সংসারে বাজারসদাই হয়। ঈদের নামাজের পর বসে না থেকে তিনি কাজে নেমে পড়েন।
মাংস হাতে বাড়িতে ফেরার সময় ভোদা মিয়া বলেন, ‘মাইনসের বাড়িত কাম করি যে টাকা পাও, তাক দিয়া নুন কিনতে পান্তা ফুরায়। ঈদ কইরবার সামর্থ্য মোর নাই; কিন্তু মুই বসিও নাই। কোরবানির একটা গরু খালে দিয়া মজুরি পাছি দেড় হাজার টাকা, মাংসও দেছে। এখন বাড়িত যাওচি ছাওয়াগুলাক নিয়া আন্দি খামো।’
বদরগঞ্জ রেলস্টেশনের নিচে কথা হয় ভ্যানচালক ফকির হোসেনের (৫২) সঙ্গে। ঈদের কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘ভাই, গরিবের ফির ঈদ আছে? নামাজ পড়িয়া ভ্যান ধরি বেরাচি। টাকা কামাই হইলে একটা ছোট বোল্ডার মুরগি কিনিয়া তাক রাইতোত কোরবানি দিয়া খামো।’