জমিতে জৈব সার প্রয়োগ, আগাছা দমনে মালচিং পদ্ধতি ও পোকামাকড় দমনে ফেরোমন ট্র্যাপের ব্যবহার হচ্ছে।
কারও জমির পরিমাণ বিশ শতক। কারও এক বিঘা। সর্বোচ্চ পাঁচ একরও আছে। কেউ লাগিয়েছেন বেগুন, টমেটো, চিচিঙ্গা, করলা। কেউবা লাউ, মিষ্টিকুমড়া। আছে শিম-পটোলের খেতও। সম্মিলিতভাবে আবাদ করছেন ৫০০ নারী-পুরুষ। পৃথক জমিতে পৃথক শস্যের আবাদ হয়েছে। তবে সবাই গত বছর আগস্ট থেকে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করছেন। এবার ফুলকপি-বাঁধাকপিতে লাভ পেয়ে বেগুন-টমেটো-করলা-চিচিঙ্গা, মিষ্টিকুমড়া আবাদে মনোযোগী হয়েছেন তাঁরা।
ফসলের মাঠ ঘুরে এ দৃশ্য দেখা যায় দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধামইর ইউনিয়নের কেশবপুর, মাটিয়ান, গিরিধরপুর, কাশিডাঙ্গা, গোবিন্দপুরসহ ২০টি গ্রামে। গত দুই দিন সংশ্লিষ্ট গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বেগুনগাছগুলোতে উঁকি দিচ্ছে ফুল। পাতার আড়ালে বাজারে বিক্রির উপযোগী সবুজ রঙের বেগুন। লুনা, ভেনচুরা, নাড়িয়া, বুলবুলিসহ বিভিন্ন জাতের বেগুনের খেত। মিষ্টিকুমড়া ও লাউয়ের লকলকে ডগায় সাদা-হলুদ ফুল। কোনোটাতে ফলও ধরেছে। টমেটোগাছে ফুটে আছে হলুদ ফুল।
কৃষকেরা বলছেন, রমজানে বাজারে এসব সবজির চাহিদা বেশি থাকে। আগাম জাতের আলু লাগানো হয়েছিল জমিগুলোতে। ভালো দামের আশায় আলু তুলে সবজি চাষে মনোযোগী হয়েছেন তাঁরা। রাসায়নিক সার–কীটনাশক ছাড়াই কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহায়তা নিয়ে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করছেন। জমিতে জৈব সার প্রয়োগের পাশাপাশি আগাছা দমনে মালচিং পদ্ধতি, পোকামাকড় দমনে ফেরোমন ট্র্যাপ, হলুদ আঠালো ফাঁদ বসানো হয়েছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘পরিবেশবান্ধব কৌশলের মাধ্যমে নিরাপদ ফসল উৎপাদন (১ম সংশোধিত)’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি বাংলাদেশের ২০টি উপজেলার ২০টি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। দিনাজপুরের বিরল উপজেলা তার একটি। প্রকল্পের আওতায় শুরুতে সংশ্লিষ্ট কৃষকের মধ্যে জৈব সার, বীজ, মালচিং পেপার, ফেরোমন ট্র্যাপ, নেট, হলুদ আঠালো ফাঁদ সরবরাহ করা হয়েছে। তবে অল্প সময়ে উপকার পেয়ে অনেক কৃষকই তাঁদের বাকি জমির মধ্যে নিজ খরচে বিষমুক্ত সবজি চাষ শুরু করেছেন। প্রায় ১০০ একর জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে।
বাজারে গিয়ে অনেক গর্ব করে বলতে পারছি, বিষমুক্ত সবজি। দামও কেজিতে দুই টাকা বেশি পাইছি।রফিকুল ইসলাম, গিরিধারী এলাকার কৃষক
গত শনিবার সকালে ধামইর ইউনিয়নের মাটিয়ান এলাকায় বেগুন তুলে বস্তায় ভরছেন কৃষক মনোয়ার হোসেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ৪০ শতক জমিতে বেগুন ও মিষ্টিকুমড়া লাগিয়েছেন। এসব পদ্ধতির উপকারিতার কথা জানালেন তাঁরা। মনোয়ার হোসেন বলেন, আগে সপ্তাহে দু-তিনবার কীটনাশক ছিটাতাম। ফাঁদ দেওয়ার পরে সেই খরচটা বেঁচে গেছে। আগে সেচ দিতে হতো সপ্তাহে অন্তত একবার। এখন সেখানে মাসে দুবার সেচ দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে নিড়ানি খরচ কমেছে। আগের নিয়মে আবাদ করলে ২০ শতকে খরচ পড়ত ৩৫-৩৬ হাজার টাকা। এখন সেখানে খরচ হচ্ছে ১৮-১৯ হাজার টাকা। ঠিকমতো ফলন হলে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কেজি বেগুন পাব। রমজানে বেগুনেরও চাহিদা বেশি। পাইকারিতে সর্বনিম্ন ২৫ টাকা কেজি দর পেলে লাভ থাকবে ৬৫-৭০ হাজার টাকা। তা ছাড়া মানুষকে বিষমুক্ত ফসল খাওয়াতে পারলাম—এতে আনন্দও আছে।
গিরিধারী এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম (৪০) ও আকরামুল হক (৩৯) বলেন, এবার নিরাপদ সবজি চাষের আওতায় ২০ শতক করে জমিতে ফুলকপি চাষ করেছিলেন। সব মিলিয়ে খরচ পড়েছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। মাত্র ৭২ দিনে ৩০ হাজার ৭০০ টাকার কপি বিক্রি করেছেন। আগের নিয়মে খরচ পড়ত পায় ১২ হাজার টাকা। আকরামুল হক বলেন, ‘পোকার অত্যাচারে সপ্তাহে তিন দিন কীটনাশক ছিটানো লাগত। এবার নিরাপদ সবজি চাষে তা দরকার হয়নি। বাজারে গিয়ে অনেক গর্ব করে বলতে পারছি, বিষমুক্ত সবজি। দামও কেজিতে দুই টাকা বেশি পাইছি।’
কৃষকদের নিয়ে ২৫টি দল করা হয়েছে। প্রকল্প থেকে কৃষকের পণ্য বাজারে নেওয়ার জন্য প্রতিটি দলে একটি করে ভ্যান দেওয়া হবে।মোস্তফা হাসান ইমাম, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা
উপজেলার কাশিডাঙ্গা এলাকার কৃষক খাদেমুল ইসলাম বলেন, ‘ফসলে এত বেশি কীটনাশক দেওয়া হতো, নিজেরা আবাদ করে সেই ফসলের তরকারি খেতে ভয় লাগত। এখন নিজেও বিষমুক্ত সবজি খাচ্ছি, অন্যকেও খাওয়াতে পারছি।’
বিরল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তফা হাসান ইমাম বলেন, নিরাপদ সবজি চাষের প্রকল্পে সফলতা দেখা যাচ্ছে। রবি মৌসুমে কৃষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সার-বীজ ও কিছু উপকরণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পরে কৃষক নিজে থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিরাপদ সবজি চাষ শুরু করেছেন। তাঁরা জৈব সারও উৎপাদন করছেন। ধামইর ইউনিয়নে কৃষকদের নিয়ে ২৫টি দল করা হয়েছে।