লালন শাহের তিরোধান উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ উৎসবে লাখো মানুষের সমাগম ঘটেছে। শুক্রবার দুপুরে ভক্তদের পূর্ণসেবা গ্রহণের মাধ্যমে শেষ হয় বাউল সাধুদের মূল আনুষ্ঠানিকতা। ছেঁউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া, ১৮ অক্টোবর
লালন শাহের তিরোধান উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণ উৎসবে লাখো মানুষের সমাগম ঘটেছে। শুক্রবার দুপুরে ভক্তদের পূর্ণসেবা গ্রহণের মাধ্যমে শেষ হয় বাউল সাধুদের মূল আনুষ্ঠানিকতা। ছেঁউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া, ১৮ অক্টোবর

বাউল–সাধুদের পদচারণায় ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে মানুষের ঢল

লাখো মানুষের স্রোত মিশেছে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়িতে। এমন জনস্রোত গত দুই দশকে কখনো হয়নি বলে মত বাউল-সাধুদের। আখড়াবাড়ি ছাড়িয়ে মানুষ রাত কাটিয়েছে এক কিলোমিটার দূরে গড়াই নদের পাড়ে। রাত যতই বেড়েছে, মানুষের জমায়েত ততই বেড়েছে। আখড়াবাড়ির দুই দিকের সড়কের এক কিলোমিটার আগে থেকে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

লাখো মানুষের উপস্থিতি আর বাউল–সাধুদের মিলনমেলায় মুখর আখড়াবাড়ি। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হওয়ার কথা থাকলেও রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিন দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, ফকির লালন শাহ ছিলেন বৈষম্যবিরোধী। তিনি (লালন) ১৩৪ বছর আগেই সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন।

আর বাউলেরা বলছেন, সাঁইজি সব সময় শান্তির বার্তা দিয়েছেন। ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান জাতি গোত্র নাহি রবে...’। চিরাচরিত নিয়মে পয়লা কার্তিক রাতে ‘অধিবাস’ শুরু করেন বাউলেরা। সাধুসঙ্গের পর রাতে বাউলেরা খিচুড়ি খেয়ে সাঁইজির আরাধনায় মত্ত থাকেন।

শুক্রবার ভোরে গোষ্ঠগানের মধ্য দিয়ে বাউলদের আচার শুরু হয়। দ্বিতীয় দিন সকালে ‘বাল্যসেবা’। এই পর্বে সকালে অনেক বাউল ‘ভেক গ্রহণ’ করেন। পায়েস মুড়ি খেয়ে গানবাজনাতত্ত্ব আলোচনা চলতে থাকে। দুপুরে হয় ‘পূর্ণসেবা’। সাদা ভাত, মাছ, কলাইয়ের ডাল, সবজি ও দই। বিকেল থেকে চলতে থাকে অবিরাম ধারায় গান। তবে আগের দিন সারা রাত গান করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া বাউল–সাধুদের অনেকেই কালী নদীর পাড়ে রাজঘাটে যান। সেখানে তাঁরা গোসল সেরে নেন।

লালন উৎসবের মূল মঞ্চে গান পরিবেশন করছেন লালন একাডেমির শিল্পীরা। ছেঁউড়িয়া, কুমারখালী, কুষ্টিয়া, ১৭ অক্টোবর

কয়েকজন বাউল বলেন, সাঁইজিকে পেতে দুদিনই যথেষ্ট। তাই তো আত্মার সম্মিলন সবকিছু শেষ করে যখন চলে যেতে হয় নিজের ডেরায়, তখনো তৃষ্ণা থেকেই যায়। যেতে চাইলেও বাদ সাধে মন। ভক্ত সাধু, গুরুর সান্নিধ্য লাভের আশায় আবার সবাই মিলিত হবেন সাঁইজির দোল উৎসবে।

বাউলেরা জানান, গুরু-শিষ্যের মধ্যে প্রকৃত প্রেম জাগে। খুঁজে নেন আত্মার মিল। পান শান্তির সুখপাখি। প্রকৃতির প্রেমে সাড়া দিয়ে প্রতিবছর এই তিরোধানে আসেন। এবার কুষ্টিয়ার ওপর দিয়ে ঢাকার একাধিক ট্রেনের যোগাযোগ থাকায় মানুষের ভিড় যেন বিগত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয়েছে। এবার মেলায় বেচাকেনাও হচ্ছে প্রচুর।

উদ্বোধনী রাতে তারকা শিল্পী বিউটি, কাঙ্গালিনী সুফিয়াসহ বিভিন্ন শিল্পী গান গেয়ে হাজারো শ্রোতার মন জয় করেন। তবে আখড়াবাড়ির মূল এলাকায় বাউলদের আচার-অনুষ্ঠান তাঁদের মতো করেই করছেন। মেলা প্রাঙ্গণের আশপাশের কার্যকলাপ একটু ভিন্ন। সেখানে মূল মঞ্চে গান চলে। পাশেই মেলায় মানুষের বেচাকেনার ভিড়।

মেলায় আকিক পাথর, আজমেরি সুতা, রুদ্রাক্ষ, শীতলগোটা, কইলজা ফল, নীলগিরি, চক্রমতির মালা, তাবিজ আর মাদুলি কেনার ধুম। সঙ্গে বাহারি রকমের জিলাপি খাওয়া চলে। কলাইয়ের রুটির দোকানের ভিড়টা যেন সব সময়ই লেগে আছে।

লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে কাল শনিবার সন্ধ্যায় আলোচনা ও রাতে মঞ্চে গানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। কিন্তু লালন মেলা চলবে আরও কয়েক দিন।