উৎপাদিত শুঁটকির বেশির ভাগই ভারতে রপ্তানি হয়েছে। এবার ১৬০ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় বেড়ে চলেছে শুঁটকির উৎপাদন। দুই উপজেলার ২৫টির বেশি শুঁটকিখোলায় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে দুই শতাধিক নারীর। দুই উপজেলার শুঁটকি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উৎপাদকেরা।
উপজেলা মৎস্য কার্যালয় ও শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা জানান, পাবনা জেলা উত্তরাঞ্চলের অন্যতম মৎস্য উৎপাদনকারী এলাকা। এর মধ্যে বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার মাছ বেশ সুস্বাদু। বেড়ায় ৭টি ও সাঁথিয়ায় ১০টি বিল রয়েছে। দুই উপজেলার মোট ১৭টি বিলে অক্টোবরের শুরু থেকে অনেক মাছ ধরা পড়ে। এ ছাড়া দুই উপজেলার নদী ও খালগুলো থেকেও ধরা পড়ে মাছ। এসব মাছের ওপর ভিত্তি করেই দুই উপজেলায় গড়ে উঠেছে অন্তত ২৫টি শুঁটকিখোলা। এসব শুঁটকিখোলা চালু থাকে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টানা প্রায় চার মাস।
পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়ার শুঁটকির মান বেশ ভালো। এর মধ্যে ভারতে রয়েছে পুঁটি শুঁটকির ভালো চাহিদা। তা ছাড়া আমরা মালয়েশিয়াতেও শুঁটকি পাঠাই।দেলোয়ার হোসেন, শুঁটকি ব্যবসায়ী
পাবনা জেলা মৎস্য কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর পাবনায় ১৫৬ টন শুঁটকির উৎপাদন হয়েছিল। উৎপাদিত শুঁটকির বেশির ভাগই ভারতে রপ্তানি হয়েছে। এবার ১৬০ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। জেলায় সবচেয়ে বেশি শুঁটকি উৎপাদন হয় সাঁথিয়া, বেড়া, সুজানগর, চাটমোহর ও ফরিদপুর উপজেলায়।
পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, পাবনায় চলনবিল, গাজনার বিলসহ ছোট-বড় বেশ কটি বিল রয়েছে। এসব বিলের মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু। এ কারণে ভারতে পাবনার শুঁটকির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পাবনার মানুষ শুঁটকি খেতে তেমন পছন্দ করেন না, তাই জেলায় উৎপাদিত শুঁটকির ৯০ ভাগের বেশি ভারতসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়। শুঁটকি রপ্তানি সামনে রেখে জেলায় শুঁটকির উৎপাদন বাড়ছে।
বেড়ার জয়নগর, হরিরামপুর, কৈতলা; সাঁথিয়ার পারকরমজা, পুণ্ডুরিয়া, শামুকজানি, ঘুঘুদহ, বড়গ্রামসহ সাত-আটটি শুঁটকিখোলা ঘুরে ব্যাপক কর্মব্যস্ততা দেখা গেছে। সেখানে কর্মরত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী। দৈনিক ২০০ থেকে ২৫০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস শুঁটকিখোলায় কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন তাঁরা।
জয়নগর গ্রামের শুঁটকি খোলায় কর্মরত শাহানা খাতুন ও রোয়া খাতুন জানান, পাশেই তাঁদের বাড়ি। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শুঁটকি খোলায় কাজ করে প্রতিদিন ২০০ টাকা করে আয় হয়। এই আয় থেকে কেউ সঞ্চয় করছেন, কেউবা সংসারের নানা জিনিস কিনছেন। একটি শুঁটকিখোলার মালিক হযরত আলী বলেন, ‘আমার খোলায় সব মিলায়া ১৫ থেকে ১৬ জন কাজ করেন। এর মধ্যে নারীর সংখ্যাই ১০ থেকে ১২ জন। শুঁটকি মৌসুমের চার মাস তাঁরা এখানে টানা কাজ করেন।’
বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বেড়ায় ১০টি ও সাঁথিয়ায় ১৫টি মিলিয়ে দুই উপজেলায় মোট ২৫টি বড় শুঁটকিখোলা রয়েছে। এবার বেড়া উপজেলায় ২৫ টন ও সাঁথিয়া উপজেলায় ৫০ টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। উৎপাদিত শুঁটকির মধ্যে রয়েছে শোল, বোয়াল, পুঁটি, খলশে, চেলা, ট্যাংরা, টাকি, চাপিলা, বাইমসহ নানা প্রজাতির দেশি মাছ। এসব শুঁটকির বড় অংশ সৈয়দপুর থেকে ব্যবসায়ীরা এসে কিনে নিয়ে যান। এ ছাড়া ঢাকা ও চট্টগামের ব্যবসায়ীরা উপজেলার বিভিন্ন শুঁটকিখোলায় এসে শুঁটকি কিনে নিয়ে যান। এখানকার শুঁটকির মান ভালো বলে ভারতের আসাম, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং মালয়েশিয়া, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হয়।
ঘুরে দেখা গেছে, শুঁটকিখোলায় পুঁটি, চাঁদা, টাকি, শোল, বোয়াল, চাপিলা, কাকিলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকানো হচ্ছে। খোলার মালিকেরা জানান, পুঁটি ও শোল মাছ সবচেয়ে বেশি শুঁটকি করা হয়। স্থানীয় জেলে অথবা মাছের আড়ত থেকে প্রতি কেজি পুঁটি মাছ ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় এবং শোল মাছ ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় কেনা হয়। শুঁটকি করার পর পুঁটি শুঁটকি আকারভেদে ২০০ থেকে ৬০০ টাকায় এবং শোল শুঁটকি এক থেকে দেড় হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বেড়া ও সাঁথিয়ায় উৎপাদিত বেশির ভাগ শুঁটকিই পাঠানো হয় সৈয়দপুর, ঢাকা ও চট্টগ্রামে। সেখান থেকে যায় বিদেশে। শুঁটকি ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘পাবনার সাঁথিয়া ও বেড়ার শুঁটকির মান বেশ ভালো। এর মধ্যে ভারতে রয়েছে পুঁটি শুঁটকির ভালো চাহিদা। তা ছাড়া আমরা মালয়েশিয়াতেও শুঁটকি পাঠাই।’
সাঁথিয়ার পুণ্ডুরিয়া গ্রামে পাবনা-ঢাকা মহাসড়কের পাশে অবস্থিত একটি শুঁটকিখোলায় গিয়ে দেখা যায়, ১৪ জন নারী ও ৮ জন পুরুষ কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে শুঁটকিখোলার মালিক সাইফুল ইসলাম ও জহুরুল ইসলাম ছিলেন। তাঁরা জানান, এই শুঁটকিখোলা সাঁথিয়া ও বেড়ার মধ্যে সবচেয়ে বড়। আট বছর ধরে তাঁরা শুঁটকি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তিন-চার মাসে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ টাকা দামের সাত-আট টন শুঁটকি উৎপাদিত হবে বলে তাঁরা আশা করছেন। গত বছর এই শুঁটকিখোলা থেকে সব খরচ বাদ দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা লাভ হয়েছিল। এবার আরও বেশি লাভের আশা করছেন তাঁরা।
বেড়া ও সাঁথিয়া দুই উপজেলারই মৎস্য কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন মো. নাসিরউদ্দিন। তিনি বলেন, বেড়া ও সাঁথিয়ার বিলগুলো মাছের জন্য বিখ্যাত। দুই উপজেলার শুঁটকির রয়েছে আলাদা সুনাম। এখানে উৎপাদিত শুঁটকির উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশেও রপ্তানি হয়। আর দুই উপজেলার শুঁটকিখোলায় অনেক নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।