দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় হঠাৎ পুলিশের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন আবদুস ছামাদ। এরপর ইচ্ছা থাকলেও চাকরির চাপে আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। সেটা ১৯৮৭ সালের কথা। এর ৩৭ বছর পর এসে এসএসসি পাস করেছেন তিনি।
আবদুস ছামাদের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার গড়গড়ি ইউনিয়নের আশরাফপুর গ্রামে। তিনি বর্তমানে ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে বগুড়ায় কর্মরত। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় তিনি কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন নাটোরের লালপুর উপজেলার মোহরকয়া নতুন পাড়া মাধ্যমিক কারিগরি ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট থেকে জিপিএ-৪ দশমিক ২৫ পেয়েছেন। আজ রোববার এ ফল প্রকাশিত হয়। ৫৭ বছর বয়সে এসে আবদুস ছামাদের এমন সাফল্যে পরিবারের পাশাপাশি আনন্দিত সহকর্মীরাও।
চাকরিজীবনের শেষের দিকে এসে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করা মোটেও সুখকর ছিল না আবদুস ছামাদের। তিনি বলেন, ‘বছর দুয়েক আগে সিদ্ধান্ত নিই—পড়াশোনা করব, আবার স্কুলে ভর্তি হব। স্ত্রী-সন্তানেরাও উৎসাহ দিলেন। ঈশ্বরদী ট্রাফিক পুলিশে চাকরির সময় এসএসসিতে (ভোকেশনাল) ভর্তি হই পাশের লালপুর উপজেলার বিলমারিয়া মোহরকয়া নতুন হাট মাধ্যমিক কারিগরি ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউটে।’
তখন পরিবারসহ ঈশ্বরদীতেই থাকতেন আবদুস ছামাদ। এরই মধ্যে পাবনা আদালত পুলিশে বদলি হয়ে যান। এতে হতাশ হলেও ভেঙে পড়েননি। পাবনা থেকেই লালপুরে এসে এ বছরের এসএসসি (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় অংশ নেন। ছামাদ বলেন, ‘বিশ্বাস ছিল, এসএসসিতে ভালো ফলাফল করব। কিন্ত অল্প সময়ে পাবনায় বদলির আদেশ এল, খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করে পরীক্ষাটা দিলাম। ফলাফলে আমি খুশি।’
অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে পড়াশোনায় বয়স যে কোনো বাধা নয়, তা প্রমাণ করেছেন আবদুস ছামাদ। তাঁর এ সাফল্যে আবারও প্রমাণ হয়েছে, শিক্ষার কোনো বয়স নেই।সুমন রঞ্জন সরকার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক), বগুড়া
ছামাদের স্ত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, এমনও ঘটনা ঘটেছে, সারা দিন ডিউটি করে রাত ১২টার দিকে বাইরে থেকে বাসায় ফিরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে বই খুলে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনাকে খুব সিরিয়াসভাবেই নিয়েছিলেন তিনি। এ কারণেই ভালো ফল করতে পেরেছেন।
পাবনা থেকে মাস দুয়েক আগে বগুড়া ট্রাফিক পুলিশে কনস্টেবল হিসেবে যোগদান করেন আবদুস ছামাদ। তিনি বলেন, ‘দুই বছর আট মাস পর চাকরি থেকে অবসর নিতে হবে। অবসরের পর বাকি জীবন মানুষের কল্যাণে কাজে লাগাতে চাই। এই বয়সে ডাক্তারি পড়ার তো সুযোগ নেই। এ কারণে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাব। বগুড়ায় হোমিওপ্যাথিক কলেজে ভর্তি হতে চাই। চার বছরের ডিপ্লোমা কোর্স শেষ হলে তত দিনে চাকরি থেকে অবসর নিতে হবে। হাতে অফুরন্ত সময়। রাজশাহীর বাঘাতে ফিরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসালয় খুলে মানুষের সেবা করে বাকিটা সময় কাটিয়ে দিতে চাই।’
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, এসএসসি পাসের পর করোনার কারণে পড়াশোনা বন্ধ হয় আবদুস ছামাদের বড় ছেলে শামিম আহম্মেদের। তিনি বর্তমানে ঢাকায় একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। ছোট ছেলে সিহাব আহম্মেদ পাবনা সরকারি পলেটেকনিক ইনস্টিটিউটের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। বিবিএ পাসের পর একমাত্র মেয়ে সীমা খাতুনকে বিয়ে দিয়েছেন।
আবদুস ছামাদের বাবা হাটে হাটে শাড়ি-লুঙ্গি বিক্রি করতেন। তিন ভাই ও এক বোনের অভাবের সংসার ছিল। টানাটানির সংসারে দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পুলিশে যোগ দেন। নিজের পড়াশোনার কথা বলতে গিয়ে আবেগে গলা ভারী হয়ে আসে আবদুস ছামাদের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরির স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বাবার অভাবের সংসারে একটু সচ্ছলতা ফেরাতে স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই পুলিশের চাকরিতে যোগ দিই। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় চাকরিতে পদোন্নতিও হয়নি। সংসারে আর্থিক টানাপোড়েন আছে। এর মধ্যেও ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হতে দিইনি। একসময় মাথায় আসে, পড়াশোনা তো জানি না, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর কী করব? অশিক্ষিত মানুষকে তো কেউ চাকরি দেবেন না। ঘরে বসে খেলে তো সংসার চলবে না।’ এরপরই তিনি আবারও পড়াশোনার সিদ্ধান্ত নেন।
কনস্টেবল আবদুস ছামাদ পুলিশ বিভাগে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলে মনে করেন বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) সুমন রঞ্জন সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে পড়াশোনায় বয়স যে কোনো বাধা নয়, তা প্রমাণ করেছেন আবদুস ছামাদ। তাঁর এ সাফল্যে আবারও প্রমাণ হয়েছে, শিক্ষার কোনো বয়স নেই। চাইলে যেকোনো বয়সেই পড়াশোনা করা যায়। তিনি তুলনামূলক ভালো ফলাফলও করেছেন। লেখাপড়ার প্রতি তাঁর এই আগ্রহ নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।