‘বড়কর্তা একটি মুখে তুলেই চোখ বন্ধ করে রইলেন আড়াই মিনিট। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই আবার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ফের। আবার।’ বড়কর্তা কী মুখে তুলেছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’ গল্পের এই বাক্য আমাদের সবারই চেনা।
বাঙালির খাদ্যবিলাসের বিভিন্ন ধাপে রসগোল্লা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে আছে। এমন এক রসগোল্লার নাম ‘সাদেক গোল্লা’। এই স্পঞ্জ রসগোল্লা মিলবে যশোরের শার্শা উপজেলার জামতলা বাজারে। প্রায় ৭০ বছর ধরে জনপ্রিয় জামতলা বাজারের সাদেক গোল্লা।
‘সাদেক গোল্লা’ নামের এই মিষ্টির কারিগর ছিলেন শেখ সাদেক আলী। তিনি মারা গেছেন। বাবার হাতের তৈরি সেই সন্দেশের স্বাদ এখনো ধরে রেখেছেন তাঁর পাঁচ ছেলে এবং এক নাতি।
যশোর শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে যশোরের শার্শা উপজেলার নাভারণ মোড়। সেখান থেকে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ধরে ৮ আট কিলোমিটার গেলে ছোটবাজার জামতলা। এই জামতলা বাজারে একটি বটগাছের নিচে সাদেক গোল্লার আদি দোকান। পরিধি বেড়ে দোকান হয়েছে পাঁচটি। তিনটি জামতলা বাজারে, একটি যশোরের নাভারণ বাজারের সাতক্ষীরা বাসস্ট্যান্ডে এবং অপরটি যশোর শহরের দড়াটানায়। জেলার বাইরেও সুনাম রয়েছে এই সাদেক গোল্লার।
সম্প্রতি দোকানে গিয়ে কথা হয়, শেখ সাদেক আলীর দুই ছেলের সঙ্গে। এর মধ্যে মো. নূরুজ্জামানের দোকান জামতলা বাজারে এবং শাজাহান কবীরের দোকান যশোর শহরে। তাঁরা জানান, জামতলা বাজারে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশে তাঁর বাবার চায়ের দোকান ছিল। প্রতিদিন গোয়ালারা দোকানে গরুর দুধ দিয়ে যেতেন। ১৯৫৫ সালের ঘটনা। এক দিন গোয়ালারা বেশি দুধ আনলে তাঁর বাবা তা কিনতে চাননি। এ সময় কুমিল্লার এক ব্যক্তি তাঁর বাবাকে দুধ রেখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি রাতে দুধ দিয়ে মিষ্টি বানিয়ে দেবেন বলে জানান। তাঁর শেখানো পদ্ধতিতে সাদেক গোল্লার শুরু। স্বাদ ও মানে অনন্য হওয়ায় দ্রুত এই মিষ্টির সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এর স্বাদের গল্প দেশের সীমানা ছাড়িয়ে যায়। প্রবাসীরা ফিরে যাওয়ার সময় এখান থেকে সাদেক গোল্লা নিয়ে যান। অনেকে বিদেশে বসেই চেয়ে পাঠান। তাঁরা জানান, ১৯৯৯ সালে তাঁর বাবা শেখ সাদেক আলী মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর মিষ্টির সুনাম ধরে রাখতে হাল ধরেন ছয় ছেলে। এক ছেলে মারা গেছেন। এখন পাঁচ ছেলে এবং এক নাতি সাদেক গোল্লা তৈরি করেন।
সাদেক গোল্লা কীভাবে বানান, জানতে চাইলে শাজাহান কবীর ও মো. নূরুজ্জামান বলেন, কড়াইতে ভালো করে জ্বাল দিয়ে প্রথমে দুধের ছানা তৈরি করা হয়। ছানা তৈরির জন্য আগের দিনের রাখা ছানার পানি নির্দিষ্ট পরিমাণে জাল দেওয়া দুধের সঙ্গে মেশাতে হয়। ছানা হলে তা একটি কাপড়ে বেঁধে পানি ঝরানোর জন্য ঝুলিয়ে রাখা হয়। পানি ঝরা শেষ হলে চাপ দিয়ে ছানা পানিশূন্য করে শুকনো করা হয়। এরপর ছানা দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির বল (গুছি) তৈরি করা হয়। আলাদা পাত্রে মাঝারি আঁচে চিনি জ্বাল দিয়ে হালকা রস তৈরি করতে হয়। রস ফুটে উঠলে ছানার বলগুলো দিতে হয়। বলগুলো ফুলে উঠলে এক থেকে দুই ঘণ্টা ঠান্ডা করতে হয়। এভাবে তৈরি হয় সাদেক গোল্লা। পলিথিনের প্যাকেটে ছয় টাকা দামের ২০টি, ১২ টাকার ১০টি, ২৪ টাকার পাঁচটি এবং সাদা রঙের ১২ টাকা দামের ১০টি করে বিক্রি হয়। এ ছাড়া বড় আকারের সাদেক গোল্লা ৩০ টাকা, মাঝারি ২০ টাকা এবং ছোট আকারের সাদেক গোল্লা ১০ টাকা করে বিক্রি হয়। একেকটি সাদেক গোল্লার ওজন সাধারণত ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম হয়ে থাকে।
গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি হয় সাদেক গোল্লা। তেঁতুল, বেল, বাবলা ও মেহগনি কাঠের জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। রসটাও হালকা হয়। এ জন্য সাদেক গোল্লা সুস্বাদু হয়।
মো. নূরুজ্জামান বলেন, ‘গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি হয় সাদেক গোল্লা। তেঁতুল, বেল, বাবলা ও মেহগনি কাঠের জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। রসটাও হালকা হয়। এ জন্য সাদেক গোল্লা সুস্বাদু হয়।’ তিনি আরও বলেন, জামতলা বাজারে আরও কয়েকটি দোকানে স্পঞ্জের রসগোল্লা বিক্রি হয়। বাইরে থেকে এসে অনেকে সেসব মিষ্টি কেনেন। তবে আসল রসগোল্লার স্বাদ পেতে সাদেক গোল্লা কিনতে হবে।
জামতলা বাজারে মিষ্টি কিনতে এসেছিলেন শার্শা উপজেলার গোগা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মফিজুল ইসলাম (৬৪)। তিনি বলেন, ‘৩৫ বছর ধরে আমি সাদেক গোল্লা খাই। এর স্বাদের কোনো তুলনা নেই। সাদেক গোল্লা নির্ভেজাল। অনেক জায়গায় রসগোল্লা খেয়েছি, কিন্তু সাদেক গোল্লার স্বাদ আর কোথাও পাইনি।’