পেট্রল পাম্পের গাড়ি চালিয়ে সংসার চালান ফয়েজুর মোল্যা (৫০)। বড় ছেলে ও এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ফয়েজুরের সংসার। জমিজমা তেমন কিছুই নেই। চার বছর আগে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দুটি গরু কিনেছিলেন। খামারে গরু বেড়ে হয়েছিল চারটি; যার আনুমানিক বাজারমূল্য ছিল তিন লাখ টাকা। ছয় মাস আগে এক রাতে সেই খামারে হানা দেয় চোরের দল। ২০ মিনিটের মধ্যে চুরি করে নিয়ে যায় গরুগুলো।
ফয়েজুর মোল্যার বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর এলাকায়। গরু চুরির সেই রাত সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সেদিন রাত ২টা ২০ মিনিট পর্যন্ত গরু পাহারা দিছি। এরপর ঘরে গিছি। মিনিট বিশেক পরে বাইরে আইসে দেহি আমার খামারে একটা গরুও নাই। ঋণের টাকায় গরু কিনে পাইলে-পুইষে বড় বানালাম। চোরেরা গরুগুলো নিয়ে আমারে পথে বসায় দিয়ে গেল। পাম্পের গাড়ি চালাইয়ে যা আয় করতাম, তা দিয়ে খাইয়ে-পইরে বাকি সব খরচ করতাম ওই গরুর পিছনে। চার বছর ধরে কষ্ট করে বানানো খামারডা ধ্বংস করে দেল। আমারে একেবারর পঙ্গু কইরে দিয়ে গেল।’
ফয়েজুর মোল্যা আরও বলেন, ‘আমি যেহানে কাজ করি, তাঁরা এট্টা গরু কিনে দেছে পুষার জন্যি। সেই গরুডা এহন খামারে আছে। সব সময় আতঙ্কে থাকি। আগের ঘটনা মনে পড়লি রাতে ঠিক মতো ঘুম হয় না। কহন যানি এই গরুডাও নিয়ে যায়।’
শুধু ফয়েজুর মোল্যা নন, তুলারামপুর এলাকায় অনেকের গরু চুরি হয়েছে; নিঃস্ব হয়ে গেছে অনেক পরিবার। স্থানীয় ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যমতে, গত ছয় মাসে ওই এলাকার রেজাউল তরফদার, সজল কুমার বিশ্বাস, কামরুল ইসলাম, আবদুর রহিম শেখ, ফকরুল ইসলাম, ইয়াকুব মোল্যা, আলমগীর মোল্যা, শামীম সিকদারসহ অন্তত ১৫টি বাড়ি থেকে ৩৯টি গরু চুরি হয়েছে।
এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী বেতেঙ্গা ও দুর্বাজুড়ি এলাকা থেকেও গরুর চুরির ঘটনা ঘটেছে। মূলত, যশোর-নড়াইল মহাসড়কের পাশের বাড়িগুলোতে বেশি চুরি হয়। কারণ, সেখান থেকে গাড়িতে করে সহজেই গরুগুলো সরানো যায়।
এ দিকে লাগাতার গরু চুরির ঘটনায় অতিষ্ঠ স্থানীয় বাসিন্দারা। চোর ধরতে পাহারা দিয়েও লাভ হয়নি। ধাওয়া দিলে পালিয়ে যায় চোরের দল। তবে অধিকাংশ ঘটনায় থানা-পুলিশে অভিযোগ দেননি ভুক্তভোগীরা। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে তুলারামপুর এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হান্নান তরফদারের বাড়িতে গরু চুরি করতে আসে একদল চোর। বিষয়টি টের পেয়ে হান্নান প্রতিবেশীদের মুঠোফোনে জানান। তখন আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন এবং মসজিদে মাইকিং করা হয়। স্থানীয় লোকজন চোর চক্রের সদস্যদের ধাওয়া করে তিনজনকে আটক করেন। অন্য একজন পালিয়ে যান। বিক্ষুব্ধ লোকজনের পিটুনিতে ঘটনাস্থলে তিনজনের মৃত্যু হয়।
গরু চুরির পর পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে গেছে। সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছে। যার কারণে মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।রেজাউল তরফদার, স্থানীয় বাসিন্দা
এর আগে গত ২৭ সেপ্টেম্বর শামীম সিকদারের বাড়ি থেকে দুইটা গরু চুরি হয়। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি থেকে প্রায় আড়াই লাখ টাকা মূল্যের দুইটি গাভি চুরি হয়। এর ৮–১০ দিন পর কামরুল ভাইয়ের বাড়ি থেকে একটা গাভি চুরি হয়। এরপর চোরের দল কয়েক জায়গায় হানা দিছে, কিন্তু নিতে পারেনি।’
রেজাউল তরফদার নামে কলেজের এক প্রভাষক বলেন, ‘বাড়িতে সিন্ধি জাতের গাভি পুষেছিলাম। তা থেকে একটি এঁড়ে বাছুর জন্মেছিল। মাস ছয়েক আগে আমার গরুগুলো চুরি করে নিয়ে যায়৷ এত টাকার গরু এভাবে চুরি হওয়ার পর গরু পালন ছেড়ে দিছি।’
ক্ষোভ প্রকাশ করে রেজাউল তরফদার আরও বলেন, ‘গরু চুরির পর পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে গেছে। সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছে। যার কারণে মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষোভ থেকেই মানুষ গত মঙ্গলবার চোরদের পিটিয়ে মেরেছে।’
চুরি প্রতিরোধে প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া পুলিশের টহল থাকবে।সাজেদুল ইসলাম, ওসি, নড়াইল সদর থানা
এ বিষয়ে নড়াইল সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি অল্প কয়েক দিন হলো দায়িত্ব পেয়েছি। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার চুরি করতে আসা চোর দলের তিনজনকে বিক্ষুব্ধ জনতা পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে। এ ছাড়া আর কোথাও কোনো চুরির খবর বা তেমন কোনো অভিযোগ পাইনি।’
ওসি সাজেদুল ইসলাম আরও বলেন, ‘চুরি প্রতিরোধে প্রতিটি এলাকায় স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। এ ছাড়া পুলিশের টহল থাকবে। জনগণের প্রতি আহ্বান, যেকোনো ঘটনা ঘটলে যেন আমাদের জানান। আমরা ব্যবস্থা নেব। কেউ যেন আইন নিজ হাতে তুলে না নেন।’